ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

সর্বোচ্চ মৃত্যু ময়মনসিংহে

শীতজনিত রোগে দেড় মাসে ২৯ জনের মৃত্যু

আক্রান্ত এক লাখ ছুঁইছুঁই

শীতজনিত রোগে দেড় মাসে ২৯ জনের মৃত্যু

ফাইল ছবি

 তবিবুর রহমান

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:০১ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:৫২

পঞ্জিকার হিসাবে শীতকাল (পৌষ ও মাঘ) শুরু কাল। এর আগেই হেমন্তের হিমেল বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শীত। সঙ্গে নিয়ে এসেছে শীতজনিত রোগ। গত ১ নভেম্বর থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় দেড় মাসে ঠান্ডাজনিত শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ এবং ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

ওই প্রতিবেদন অনুসারে, এসব রোগে আক্রান্ত হয়েছে ৯৯ হাজার ৫১৭ জন। সেই হিসাবে সারাদেশে দৈনিক শীতজনিত রোগ নিয়ে হাসপাতালে সেবা নিয়েছে ২ হাজার ৩১৪ জন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, শীতে আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় বাতাসে জীবাণুর পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে বিভিন্ন কারণে শীতজনিত রোগব্যাধির আগমন ঘটে। এবারও এ ধরনের রোগব্যাধি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, টনসিলাইটিস, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ (ব্রঙ্কিওলাইটিস), সাইনোসাইটিস, বাত, আর্থ্রাইটিস ও চামড়ার শুষ্কতা অন্যতম। এ সময় শীতে এসব রোগ থেকে মুক্ত থাকার জন্য ঠান্ডা অনুসারে গরম কাপড় ব্যবহার, যতটা সম্ভব ঠান্ডা পরিবেশ এড়িয়ে চলা জরুরি।

বিভাগভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শীতজনিত সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত রোগী চট্টগ্রামে। এ বিভাগে গত দেড় মাসে ২৬ হাজার ৪৯৪ রোগী ভুগছেন।
এ ছাড়া রংপুরে ২০ হাজার ৮০৩ জন, খুলনায় ২০ হাজার ৩৩ জন, ঢাকা বিভাগে (মহানগর ব্যতীত) ১৩ হাজার ৪৫৮ জন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন। আর ময়মনসিংহে ৪ হাজার ৭৪৬ জন, রাজশাহীতে ৬ হাজার ১৩৭ জন, বরিশালে ৫ হাজার ৬৬৬ জন ও সিলেট বিভাগে ৬ হাজার ৩৭৪ জন শীতজনিত সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন।
এসব সংক্রমণে মারা যাওয়া ২৯ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহের বাসিন্দা, ১১ জন। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ৭ জন, ঢাকা বিভাগের পাঁচজন, বরিশালে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া সিলেট ও খুলনায় একজন করে মারা গেছেন।

গতকাল সরেজমিন রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের শিশু বিভাগে দেখা গেছে, নিউমোনিয়া ও জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা বেশি। দুই ওয়ার্ডে ৪০ শয্যায় রোগী ভর্তি রয়েছে ৯৮ জন। ধারণক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ রোগী থাকায় হিমশিম খাচ্ছেন নার্স ও চিকিৎসকরা। 

শিশু ওয়ার্ডে মায়ের কোলে কান্নাকাটি করছিল রাকিব হোসেন। তার চার বছর দুই মাস। হাতে ক্যানোলা লাগানো আর নাকে স্যালাইনের নল। শ্বাসকষ্ট না কমায় শিশুটির মুখে নেবুলাইজার দিয়ে রাখছেন তার মা তানিয়া সুলতানা। তিনি জানান, তার বাচ্চা চার দিন ধরে এখানে ভর্তি। কিছুই খাচ্ছে না। শুধু কান্নাকাটি আর খিঁচুনি দিয়ে ওঠে। মেঝেতে থাকার কারণে বাচ্চাটার অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে।

হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, মেঝে ও বারান্দায় পাটি, কাঁথা-বালিশ বিছিয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ও তাদের স্বজনসহ অসংখ্য মানুষ-শুয়ে বসে রয়েছেন। সেখানে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন রোগীরা।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের নবজাতক ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. শাকিল সরোয়ার সমকালকে বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে জ্বর, ঠান্ডা, কাশি, নিউমোনিয়া, ও শীতকালীন ডায়রিয়ায় শিশুরা অনেক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিবছর এমন চিত্র দেখা যায়। এসব রোগ প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই। শীতজনিত রোগ থেকে রক্ষায় শিশুর গরম পোশাক পরিধান করাতে হবে। মাঝে মাঝে মধু, চিনিসহ গরম পানি পান করাতে হবে। বাসার বাইরে গেলে অবশ্যই শীত প্রতিরোধী পোশাক পরতে হবে। শুধু শিশুদের নয়, একই পরামর্শ বয়স্কদের জন্য। জ্বর, ঠান্ডা, কাশি, নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে শিশুকে অবশ্যই হাসপাতালে নিতে হবে।

ময়মনসিংহে বেশি মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘ভারত সীমান্তঘেঁষা জেলার গারো পাহাড়ি জনপদে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস। ঠান্ডায় কাজ করতে হচ্ছে তাদের। এতে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত জটিলতা বেশি দেখা দিচ্ছে। তবে মৃত্যু বেশি কেন তা বলতে পারব না।’

চট্টগ্রামে আক্রান্ত বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ নুরুল হায়দার বলেন, ‘শীত বাড়ায় নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত জটিলতাসহ বিভিন্ন রোগ বাড়ছে। এ ছাড়া আমাদের রিপোর্টিংয়ের মান আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। প্রত্যেক রোগীর তথ্য প্রতিবেদনে চলে আসছে। আগে সেভাবে রোগীর তথ্য সংরক্ষণ করা হতো না।’ সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব মনে বলেন এই বিশেষজ্ঞ।

চুয়াডাঙ্গায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ
দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা গতকাল সকাল ৯টায় রেকর্ড হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৮ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান জানান, শনিবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ডের সময় চুয়াডাঙ্গায় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৮৫ শতাংশ। আগামী দু’দিন তাপমাত্রা আরও কমে মঙ্গলবার থেকে বাড়তে পারে। ৮ দশমিক শূন্য ১ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত মৃদু শৈত্যপ্রবাহ ধরা হয়। এ হিসেবে এ জেলার ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বইছে বলে জানান তিনি।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ১৫ শয্যার শিশু ওয়ার্ডে গতকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত ভর্তি ছিল অন্তত ৫০ শিশু। আর ডায়রিয়া ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ৭০ জন।
ডায়রিয়া ওয়ার্ডে কথা হয় আলমডাঙ্গার গড়গড়ি গ্রামের বৃষ্টি খাতুনের সঙ্গে। তিনি জানান, তিন মাস বয়সী শিশু নিয়ে তিন দিন হাসপাতালে আছেন। এখনও শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছেন।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের চিকিৎসক মাহবুবুর রহমান মিলন জানান, ইদানীং রোটা ভাইরাস ও ঠান্ডায় শিশুরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে ডায়রিয়া বেশি হচ্ছে। তবে পাঁচ দিন পর ভাইরাস মারা গেলে তারা সুস্থ হয়ে উঠছে। এ সময় শিশুদের বাসি খাবার দেওয়া যাবে না। বাড়তি যত্ন নিতে হবে। গরম কাপড়ে যতটা সম্ভব ঢেকে রাখতে হবে।

কুড়িগ্রামে কনকনে ঠান্ডা
কনকনে শীতে কাবু হয়ে পড়েছেন কুড়িগ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষ। ঘন কুয়াশার কারণে দুপুরে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। গতকাল জেলা শহরের একাধিক এলাকা ঘুরে সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত দেখা মেলেনি সূর্যের।

কুয়াশার কারণে মোগলবাসা ও যাত্রাপুর নৌঘাট এবং চিলমারী নৌবন্দর থেকে নৌকা ও ফেরি ছাড়তে পারেনি। বন্দরে আটকা পড়েছে পাথরবোঝাই বহু ট্রাক। একই কারণে প্রায় ৩ ঘণ্টা দেরিতে ঢাকা ছেড়ে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস আন্তঃনগর ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছায়।

পঞ্চগড়ে হাড় কাঁপানো শীত
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া অফিস গতকাল সকাল ৯টায় সর্বনিম্ন ৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে। শুক্রবার এটি ছিল ৮ দশমিক ৪। প্রতিদিন বিকেল থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকছে এলাকা। দুপুরে ঝলমলে রোদের দেখা মিললেও অনুভূত হয় হাড় কাঁপানো শীত। দুর্ভোগ বেড়েছে রিকশা-ভ্যানচালকসহ নিম্ন আয়ের মানুষের।

সুন্দরগঞ্জে মাঠে যাওয়া যাচ্ছে না
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে টানা ১০ দিন ধরে তীব্র শীতে অসহায় ও ছিন্নমূল মানুষ কাবু হয়ে পড়েছেন। তিস্তা নদীর চরাঞ্চলের ভাসমান পরিবারগুলো দুর্বিষহ দিন পার করছেন। স্থবির হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক কার্যক্রম।

দহবন্দ ইউনিয়নের দক্ষিণ ধুমাইটারি গ্রামের দিনমজুর বেলাল হোসেন জানান, ঠান্ডার কারণে মাঠে কাজে যেতে পারছেন না তারা। মাঝে মধ্যে খড়কুটো জ্বালিয়ে হাত-পা গরম করতে হচ্ছে।

হরিপুর চরের বৃদ্ধ আবুল কাশেম মিয়া বলেন, ‘ঠান্ডাত হ্যামরা মরি গৈইনো বাহে। কেডা হ্যামাক ঠান্ডার কাপড় দিবে? আজ কইদিন থাকি আগুন জ্বলেয়া ছাওয়াল-পোয়াল বাড়িওয়ালিকে নিয়ে কষ্ট করি রাতদিন পার করছি। হ্যামার ঘরে খুব কষ্ট হইছে।’

তারাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম জানান, সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়নি। শীতার্তদের তোপে পড়তে হচ্ছে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মশিয়ার রহমান জানান, গত ১০ দিন ধরে তীব্র ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। সরকারিভাবে ২০০টি কম্বল পাওয়ার পর ইউপি চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে।

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলা প্রতিনিধিরা)


 

আরও পড়ুন

×