এই রায় জনগণের গুরুত্বপূর্ণ বিজয়

বদিউল আলম মজুমদার
বদিউল আলম মজুমদার
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:১০ | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:০৬
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার রায় জনগণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। কারণ, এ দেশের জনতা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের এই অধিকার হরণ করা হয়েছিল। এখন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর আদালতের রায়ের মাধ্যমে সংবিধানে আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসছে। শুধু ফিরেই আসছে না, আদালত এটিকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বলে চিহ্নিত করেছেন।
এর ফলে ভবিষ্যতে আপিল বিভাগে চ্যালেঞ্জ হলেও বাতিলের সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারও পক্ষে এটি বন্ধ করাও সম্ভব হবে না এবং এটি আমাদের সংবিধানে স্থায়ী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। এটাতে আমাদের জাতির বুকের ওপর থেকে একটি বিরাট জগদ্দল পাথর সরে গেল। যার ফলে আমাদের গণতান্ত্রিক যাত্রাপথটা কণ্টকমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
অনেক দিন থেকেই আমরা এ বিষয় নিয়ে কাজ করছিলাম। এটি নিয়ে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রাজনীতি’ নামে একটি বইও লিখেছি। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেন অবশ্যই সংবিধানে থাকতে হবে, সে বিষয় তুলে ধরেছি। ওই বইয়ে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে, তার ভিত্তিতে পঞ্চদশ সংশোধনীর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হয়। আমি ছিলাম রিট পিটিশনার এবং একই সঙ্গে আরও একজন পক্ষভুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এবং কিছু ব্যক্তিও এর সঙ্গে পক্ষভুক্ত হয়েছেন। সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল চেয়েছেন।
এ রায়ের মাধ্যমে আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার বাইরেও আরও কয়েকটি কাজ করেছেন। তারা সংবিধানের ৭(ক) ও ৭(খ) অনুচ্ছেদ দুটি বাতিল করেছেন। ৭(ক)-এর মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায় সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা করার জন্য উদ্যোগ নিলে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করার বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। এই বিধান এসেছে পাকিস্তান থেকে। আদালত এটি বাতিল করেছেন। আর সংবিধানের ৭(খ) অনুচ্ছেদে পঞ্চদশ সংশোধনীকে অসংশোধনযোগ্য করা হয়েছিল। এ দুটি অনুচ্ছেদ আদালত বাতিল করেছেন। এ ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ১৪২ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে গণভোটের বিধান বাতিলের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, আদালত সে সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন। ফলে সংবিধানের প্রস্তাবনা ও কিছু অনুচ্ছেদ সংশোধনে আদালতের রায়ে গণভোটের বিধান ফিরে আসছে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দু’ভাবে কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একটি হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। আরেকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সংবিধানে ৭(ক) অনুচ্ছেদ যুক্ত করার মাধ্যমে। সংবিধান সম্পর্কে কোনো রকম জনগণের আস্থা পরাহত করা এবং এ সংবিধান সম্পর্কে কোনো রকম সমালোচনা করা– এগুলো হলো রাষ্ট্রদ্রোহ। আমিসহ অনেক ব্যক্তি এ বিষয়ে সোচ্চার হয়েছিলাম। আদালত আমাকে এবং এ ব্যাপারে যারা সোচ্চার ছিলেন, তাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। ধন্যবাদ দিয়েছেন, কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
আদালত এই যে অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিলেন, সেগুলোকে যুগান্তকারী বলে মনে করি। আবার পঞ্চদশ সংশোধনীর বাকি অংশগুলো তারা বাতিলও করেননি কিংবা পক্ষেও কোনো রায় দেননি। তারা এগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।
মূল কথা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটা জনসমর্থনের ভিত্তিতেই সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। মানুষ এটিকে গ্রহণও করেছিল। কেননা এ ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষ যাদের সমর্থন করছিল, তারাই নির্বাচিত হচ্ছিলেন। ফলে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা নিয়ে ব্যাপক একটি গণঅসন্তুষ্টি বিরাজ করছিল। তা ছাড়া এটি সংবিধানের অনেক পদ্ধতিগত ত্রুটি নিয়েই পাস করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে সংবিধান লঙ্ঘনও করা হয়েছিল। এখন আদালতের মাধ্যমে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হওয়া নিঃসন্দেহে জনগণের গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। আমরা আশা করব, এর থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা ভবিষ্যতে এ রকম অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হবেন না।
সবশেষে বলব, আদালতের রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটা সংবিধানে আবারও অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়েছে। এতে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। এই রায়কে যুগান্তকারী রায় বলেও আমি মনে করি।
লেখক : নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)