সমকাল-ডিসিএফ গোলটেবিল বৈঠক
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চাহিদার ভিন্নতা বিবেচনা জরুরি

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকালের সভাকক্ষে রোববার আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত অতিথিরা- সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:০৫ | আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৮:৫৮
দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ ক্ষেত্রে নারী ও প্রবীণ বিশেষ করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। প্রতিবন্ধিতা মানব বৈচিত্র্যের একটা অংশ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদাও ভিন্ন ভিন্ন। এই বৈচিত্র্য এবং চাহিদার ভিন্নতা দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সব দিক থেকেই বিবেচনা করা প্রয়োজন।
গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকালের সভাকক্ষে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জলবায়ু সহনশীল দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, জীবিকা ও সামাজিক নিরাপত্তা’ শীর্ষক আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রিত অতিথিরা এসব কথা বলেন। সমকাল এবং ডিজএ্যাবল্ড চাইল্ড ফাউন্ডেশন (ডিসিএফ) যৌথভাবে এর আয়োজন করে। সার্বিক সহযোগিতায় ছিল কারিতাস বাংলাদেশ এবং সিবিএম গ্লোবাল ডিজএ্যাবিলিটি ইনক্লুশন।
ডিসিএফের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে এবং সমকালের সহযোগী সম্পাদক শেখ রোকনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক তানিয়া খান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. মো. হাবিব উল্লাহ বাহার এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা) ফরিদ আহমেদ মোল্লা। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডিসিএফের ব্যক্তি অন্তর্ভুক্তিমূলক দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, স্ট্রেংদেনিং পিপল- সেন্টারড ইনক্লুসিভ ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইন খুলনা অব বাংলাদেশ (ডিআইডিআরএম) প্রজেক্টের টেকনিক্যাল কোঅর্ডিনেটর আবু হানিফ মোহাম্মদ ফরহাদ।
ডিআইডিআরএম প্রকল্পের বিষয়ে কথা বলেন কারিতাস বাংলাদেশের প্রোগ্রাম অফিসার নূরজাহান সুলতানা। স্বাগত বক্তব্য দেন ডিসিএফের নির্বাহী পরিচালক নাসরিন জাহান।
এ ছাড়া আরও বক্তব্য দেন ইউএনডিপির সিনিয়র অ্যাডভাইজার এস এম মন্জুর রশীদ, রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট আরজু আফরিন ক্যাথি, আমদার নির্বাহী পরিচালক সরদার এ রাজ্জাক, ডিসিএফের মেন্টাল হেলথ প্রজেক্টের প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর নাঈমা ইসলাম অন্তরা, ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব হিউমেনিটারিয়ান অ্যাক্টরস বাংলাদেশের (নাহাব) কোঅর্ডিনেটর মো. রওশন আলী, বাংলাদেশ টেলিভিশনের বাংলা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ নিউজ প্রেজেন্টার আরিফুল ইসলাম, ডিসিএফের নির্বাহী সদস্য রোকেয়া বেগম, বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থার সাধারণ সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস খান (রিপন), ঢাকা বধির সংস্থার নির্বাহী সদস্য শাহানা আক্তার, মিরপুর অ্যাসোসিয়েশন অব দি ডেফে’র সদস্য তায়েফুর রহমান রাহাত প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে রেজওয়ানুর রহমান বলেন, বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আবশ্যিকভাবে র্যাম্প (সিঁড়ির পরিবর্তে ঢালু পথ) থাকে। এর নিচতলায় বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা থাকবেন। তাদের জন্য থাকবে বিশেষ ওয়াশরুমের ব্যবস্থা। সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নারী-পুরুষের আলাদা থাকার ব্যবস্থা এবং রান্নারও ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে সৌরবিদ্যুৎ এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থাও আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আশ্রয় নেওয়া মানুষের জন্য সরকারের পৃথক পৃথক সংস্থা কাজ করে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে কীভাবে আরও ভালো করা যায়, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।
তিনি বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর যে পরিকল্পনাগুলো করে তার সবই ওপর থেকে হয় না। কিছু ক্ষেত্রে আমরা স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে পরিকল্পনা করে থাকি। আমাদের স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমন পরিকল্পনা চলমান। এতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়টি যেন থাকে তা আমরা নিশ্চিত করব। দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস করা একটা বড় বিষয়। আমরা যতটা ঝুঁকি হ্রাস করতে পারব, আমাদের ক্ষয়ক্ষতি ততটা কম হবে।
তানিয়া খান বলেন, আমাদের মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডগুলোর মধ্যে দুর্যোগকালে শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি রয়েছে। শিশু একাডেমিতে তাদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুদের বিষয়টি অগ্রাধিকার এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে থাকি। এটি আমাদের নীতিমালার মধ্যেই রয়েছে। স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুদের অংশগ্রহণের বিষয়টিও আমরা গুরুত্ব দেই।
তিনি বলেন, শিশু একাডেমির আওতায় ছয়টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষা ব্যবস্থা করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য আলাদা করে এসব সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে। অন্যসব শিশুর চেয়ে এসব প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য সুযোগ-সুবিধা একটু বেশি থাকে।
হাবিব উল্লাহ বাহার বলেন, দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ ক্ষেত্রে নারী ও প্রবীণ বিশেষ করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। আমাদের লক্ষ্য হলো– দুর্যোগকালে এবং দুর্যোগের পূর্বাপর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে– এমন বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের আলোচনার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সংবেদনশীল একটা সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
ফরিদ আহমেদ মোল্লা বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক ১৩টি প্রোগ্রাম রয়েছে। এর মধ্যে চারটি প্রোগ্রাম অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং ৯টি প্রাতিষ্ঠানিক। এই প্রাতিষ্ঠানিক প্রোগ্রামের মধ্যে তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং পুনর্বাসন সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন (এনডিডি) অটিজম, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, ডাউন সিনড্রোম এবং সেরিব্রাল পালসি– চার ধরনের প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করে। প্রতিবন্ধী আইনে উল্লিখিত ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতা নিয়ে আমরা কাজ করছি। চলতি ডিসেম্বরের প্রথম দিকে এই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আমাদের প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী নতুন কর্মপরিকল্পনা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা সে অনুযায়ী কাজ শুরু করেছি। আগের কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা নতুন কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করব। দুর্যোগ সাধারণত আকস্মিকভাবেই হয়ে থাকে। ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। এই বিষয়টি কীভাবে সামনে আনা যায়, এ নিয়ে সবাইকে কাজ করতে হবে।
নাসরিন জাহান বলেন, দুর্যোগে সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান– এগুলো একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রথম চাওয়া। এ বিষয়টি কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটি আমাদের দেখতে হবে।
শেখ রোকন বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য যদি উপযুক্ত সুযোগের ব্যবস্থা করা হয়, তারা অনেক এগিয়ে যাবেন। তারা যেন মূল স্রোতে আসতে পারেন, ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের চেয়ে এগিয়ে যেতে পারেন– এ ক্ষেত্রে সরকার একটা ভূমিকা রাখতে পারে।
আবু হানিফ মোহাম্মদ ফরহাদ বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্রের অঙ্গীকারকে ব্যক্ত করে। রাষ্ট্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন (২০১৩), সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক, ঢাকা ঘোষণাসহ বিভিন্নভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তিকরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে যে বরাদ্দ রয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়। আমাদের দাবি, দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সকল পর্যায়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অন্তর্ভুক্তিকরণ নিশ্চিত করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে হাফিজুর রহমান বলেন, সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিয়ে প্রতিবন্ধী সংগঠনগুলো স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আগামীতে আরও এগিয়ে যাবে। আমি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বলব, আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা করুণা চাই না। চাই অনুপ্রেরণা, চাই সহযোগিতা।
- বিষয় :
- দুর্যোগ মোকাবিলা
- গোলটেবিল