রাজনৈতিক টানাপোড়েনে আটকে গেল বিচারকদের ভারতে প্রশিক্ষণ

ফাইল ছবি
আবু সালেহ রনি
প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫ | ২২:০০
রাজনৈতিক টানাপোড়েনে আটকে গেছে ৫০ বিচারকের ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া। বিচারকদের ভারতে যাওয়ার জন্য গত শনিবার অনুমতি দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এক দিন পর গতকাল রোববার সেই অনুমোদন বাতিল করেছে। এর কার্যক্রম ফের চালু হবে কিনা, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। অথচ ২০১৭ সাল থেকে ভারত সরকারের অর্থায়নে অধস্তন আদালতের বিচারকদের এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের অধস্তন আদালতের ১ হাজার ১৪৬ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে ভারত। চুক্তি অনুযায়ী, পর্যায়ক্রমে সব বিচারককে এই প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা। দেশের অধস্তন আদালতে বর্তমানে ২ হাজার ১৯১ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা রয়েছেন। এর মধ্যে জেলা জজ ৩১১ জন, অতিরিক্ত জেলা জজ ৩২৬, যুগ্ম জেলা জজ ৩৫৭, সিনিয়র সহকারী জজ ৬৭৩ ও সহকারী জজ ৫২৪ জন।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১০ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি ভারতের ভোপালে অবস্থিত ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি এবং স্টেট জুডিশিয়াল একাডেমিতে ৫০ বিচারকের প্রশিক্ষণ হওয়ার কথা ছিল। এ লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে ৫০ বিচারককে ভারতে পাঠানোর বিষয়ে অনুমতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করে আইন মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপন জারি এবং তা বাতিলও করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে এটি বাতিল করা হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। তবে বাতিল হওয়ার কারণ নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ৫০ বিচারকের প্রশিক্ষণের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারির পর তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এতে বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এ কারণে প্রজ্ঞাপন জারির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা বাতিল করা হয়েছে।
তারা আরও জানান, কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিচারকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে মিথ্যাচার করা হয়েছে। আগে থেকে বিষয়টি স্পর্শকাতর। তবু ভারত সরকারের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছিল আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্ট।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভূঞা সমকালকে বলেন, ‘পট পরিবর্তনের পর বিচারকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি এক অর্থে স্থগিত ছিল। ভারত সরকারের আগ্রহে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে আইন মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। এখন আবার সেটি একইভাবে বাতিল করা হয়েছে।’
তিনি জানান, বিগত দিনে ভারতের ভোপালে তিনিও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণ কর্মশালা ফের চালু হওয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, ‘এটি সিদ্ধান্তের বিষয়। কিছুই বলা যাচ্ছে না।’
এদিকে আইন মন্ত্রণালয় থেকে প্রশিক্ষণের জন্য ৫০ জন বিচারককে ভারত যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। দলটির মহাসচিব মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী এক বৈঠকে বলেন, ‘বিচারকদের পেশাদারিত্ব অর্জন, নিরপেক্ষভাবে বিচারকাজ পরিচালনার অনুপ্রেরণা মজবুত করতে ভারতের পরিবর্তে বিজ্ঞ মুফতিদের কাছে পাঠানো উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও তারা প্রতিবেশীসুলভ আচরণ না করে প্রভুত্বসুলভ আচরণ করতে বেশি পছন্দ করে। আমাদের বিচারকদের প্রশিক্ষণ দেওয়াটাও তাদের আধিপত্যবাদী পরিকল্পনার অংশ। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে, ভারতের সঙ্গে আগের হওয়া সব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক পর্যালোচনা করা এবং বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী সব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক বাতিল করা।’
জানা গেছে, গণমাধ্যমে খেলাফত আন্দোলনে প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পর বিষয়টি সরকারের নজরে আসে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন থেকেও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। এমন পরিস্থিতিতে ভারতে যাওয়ার জন্য অনুমতি পাওয়া বিচারকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
ভারতে প্রশিক্ষণের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের একটি সারসংক্ষেপ থেকে জানা যায়, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। তবে অবকাঠামো ও অন্যান্য সমস্যার কারণে এখানে একবার প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর পরবর্তী প্রশিক্ষণ নিতে বিচারকদের প্রায় চার-পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়। এ অবস্থায় ২০১৬ সালের নভেম্বরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ভারত সফরে গিয়ে বিচারকদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের তাৎক্ষণিকভাবে নির্দেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের এপ্রিলে দুটি সমঝোতা স্মারক সই করে ভারত ও বাংলাদেশ। প্রশিক্ষণের কার্যসূচিতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন, মানবাধিকার আইন, মেডিকো-লিগ্যাল জুরিসপ্রুডেন্স, পরিবেশ আইন, চুক্তি আইন, আদালত ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
জানতে চাইলে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতে প্রশিক্ষণ নেওয়া এক বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা প্রায় একই ধরনের। ব্রিটিশ আমলের আইন ও বিধি দ্বারা এখনও বিচার ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। এ জন্য বাংলাদেশের আহ্বানে বিচারকদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে সাড়া দিয়েছে ভারত সরকার। এ নিয়ে অহেতুক মিথ্যাচার করা হচ্ছে।
- বিষয় :
- বিচারপতি
- প্রশিক্ষণ কর্মশালা