ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

নগদ ‘মূল্য’ দিলেই মিলছে বিনামূল্যের পাঠ্যবই

তদন্তে এনসিটিবির কমিটি

নগদ ‘মূল্য’ দিলেই মিলছে বিনামূল্যের পাঠ্যবই

ফাইল ছবি

সাব্বির নেওয়াজ

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ০১:১৪ | আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ০৭:৫৯

সাংবাদিক পরিচয় লুকিয়ে অভিভাবক সেজে রাজধানীর নীলক্ষেত বইয়ের বাজারে এক দোকানে কিনতে চাওয়া হলো অষ্টম শ্রেণির এক সেট পাঠ্যবই। দোকানি জানালেন– নেই। এ দোকান সে দোকান ঘুরে পাওয়া গেল না। ফিরে আসার মুহূর্তে হঠাৎ এক লোক ফিসফিস করে বললেন, কোন ক্লাসের বই লাগবে স্যার? কৌশলে জানা গেল লুঙ্গিপরা এই লোকের নাম আমিনুল। অষ্টম শ্রেণির বই লাগবে জানাতেই তিনি বললেন, পুরো সেট একদাম ৫ হাজার টাকা। রাজি হতেই এখানে দাঁড়ান বলে ঢুকে গেলেন পাশের সরু গলিতে। দুই মিনিটেই এনে দিলেন এক সেট বই। দ্রুত টাকা নিয়ে সরে গেলেন সেখান থেকে। গত শুক্রবার বিকেলের ঘটনা এটি।

এভাবেই চলতি শিক্ষাবর্ষের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ‘মূল্য’ দিলে কেনা যায় খোলাবাজারে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির একসেট বই বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার টাকায়। নবম শ্রেণির বই সেটপ্রতি (গ্রুপভেদে দু-একটি বই কম থাকছে) ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা। রাজধানীর নীলক্ষেত, বাংলাবাজারসহ দেশের অনেক স্থানে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিকিকিনির তথ্য মিলেছে। স্কুলগুলোতে ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ায় এবং পাঠ্যবই মুদ্রণ ও বিতরণে এ বছর কিছুটা দেরি হওয়ায় এমন পরিস্থিতি। গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর অনলাইন ভার্সন থেকে বই ডাউনলোড করার সুযোগ নেই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) জানিয়েছে, বিনামূল্যের পাঠ্যবই কেনাবেচার সুযোগ নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিয়ে জড়িতদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে। 

গত রোববার নীলক্ষেত বাজারে আবারও বই কিনতে যান সমকালের এ প্রতিবেদক। এবার লক্ষ্য নবম শ্রেণির এক সেট বই কেনা। বই বিক্রেতাদের চোখ-মুখ দেখে বোঝা গেল তারা খুবই সতর্ক। প্রকৃত অভিভাবক কিনা বোঝার চেষ্টা করছিলেন তারা। জানা গেল, কয়েক দিন আগে রাজধানীর বাংলাবাজারে বিপুলসংখ্যক বিনামূল্যের বই জব্দ করার পর সতর্ক হয়েছেন বিক্রেতারা। তারা দোকান থেকে বই সরিয়ে দিয়েছেন। তবে বিক্রি থামেনি। বই সরিয়ে ফুটপাতে বিভিন্ন দোকানের বস্তায় রাখা হয়েছে। এ ছাড়া মার্কেটের বিভিন্ন গোপন স্থানে রাখা হয়েছে। কিছু দোকানে পাঠ্যবই সহজেই কেনা গেছে গত শুক্রবার পর্যন্ত। দোকানে বই সাজিয়ে না রাখলেও নিচে স্টক থেকে বই বের করে বিক্রি করা হয়েছে। রোববার প্রথমে বই দেখাতে বা বিক্রি করতে রাজি হননি বিক্রেতারা। যাদের অভিভাবক বা শিক্ষক বলে মনে হয়েছে তাদের পাঠ্যপুস্তক অন্য স্থান থেকে এনে দেখান বিক্রেতারা। নীলক্ষেতে বাবুপুরা মার্কেটের বুক পেপার, বুশরা লাইব্রেরি, হাসান লাইব্রেরি, মীম বুক হাউজ, নিরালা বুক  ফেয়ারসহ বেশ কয়েকটি দোকানে ক্রেতা সেজে খোঁজ নিলে বই বিক্রির প্রমাণ পাওয়া  ‍যায়। এ ছাড়া মার্কেটের সামনে রাস্তার পাশে বিক্রেতাদের বললেও কিছুক্ষণের মধ্যেই মার্কেটের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বইয়ের সেট এনে দেওয়া হয়।

নীলক্ষেতের এক বইয়ের দোকানদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, সারাদেশে এখনও অনেক স্কুলে সব বই পৌঁছেনি। এ কারণে অভিভাবকরা বই খুঁজছেন মার্কেটে। ঢাকার বাইরে থেকেও অভিভাবকরা আসছেন। বিশেষ করে প্রাথমিকের বই, মাধ্যমিকের ইংরেজি ভার্সনের বই এবং নবম শ্রেণির বই বিক্রি হচ্ছে বেশি।
আরেক বিক্রেতা জানান, গোয়েন্দাদের ভয়ে গোপনীয়তা অবলম্বন করে বই বিক্রি করা হচ্ছে। ধরা পড়লে পুলিশি ঝামেলা হয়। বাংলাবাজার, পল্টন ও মতিঝিলের বিভিন্ন প্রেসে এসব অবৈধ বই ছাপা হচ্ছে বলে জানান তিনি। মাধ্যমিকের বই ডিসেম্বর থেকেই কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে।

বিক্রেতারা স্বীকার করেন, কালোবাজারে পাঠ্যবই বিক্রিতে ঝুঁকি থাকলেও লাভ বেশি। কোনো কোনো কালোবাজারি ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনার মতো বড় শহরেও এসব বই নিয়ে যাচ্ছেন। রাজধানীর মতিঝিল, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, মালিবাগ, নাখালপাড়ার রেলগেট-সংলগ্ন কয়েকটি লাইব্রেরিসহ বিভিন্ন স্থানে বইয়ের দোকানে অবাধে বিক্রি হচ্ছে বিনামূল্যের পাঠ্যবই।

রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক রাইসা ইসলাম অজন্তা সমকালকে জানান, গত বুধবার তিনি ফার্মগেটের একটি লাইব্রেরি থেকে সাধারণ বিজ্ঞান, সমাজ, ধর্ম, সাধারণ গণিত এবং ইংরেজি বই তিন হাজার টাকায় কিনেছেন। রোববার তিনি আবারও খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, সেখানে এখন অষ্টম শ্রেণির কৃষি এবং বাংলা বইও পাওয়া যাচ্ছে।

নীলক্ষেত ও বাবুপুরা এলাকার বইয়ের বাজার ঘুরে জানা যায়, দোকানে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে বই মিলছে না। তবে লুকিয়ে বই বিক্রি হচ্ছে। সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রির কারণ জিজ্ঞাসা করলে বিক্রেতারা বলেন, এসব বইয়ের বাড়তি দাম, তাই বিক্রি করা হচ্ছে। তবে সাংবাদিক পরিচয় জানতে পারলে মুখে কুলুপ আঁটেন দোকানিরা। ফুটপাতের কয়েকটি দোকানেও বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রি করতে দেখা গেছে।

বই যেভাবে কালোবাজারে
ছোট বা মাঝারি লাইব্রেরি থেকে চাহিদা অনুযায়ী কাজ নেওয়া বিভিন্ন প্রেস অবৈধভাবে বই ছাপাচ্ছে বলে সরকারের সন্দেহ। অনেক ক্ষেত্রে এতে জড়িত জেলা এবং উপজেলা শিক্ষা অফিসগুলো। এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, দেশের অনেক জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বই চাওয়া হয়েছে। সেখান থেকেই কালোবাজারে চলে যাচ্ছে বই। এ ছাড়া অনেক স্কুলও বেশি বইয়ের চাহিদা দিয়েছে। সেসব স্কুল কর্তৃপক্ষ সরকার থেকে বই পেয়ে তা কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। এ ছাড়া কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান সরকারের কার্যাদেশের বেশি বই ছাপিয়ে বিক্রি করছে। বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, আরামবাগ ও নয়াপল্টনের মুদ্রণ, ছাপা ও বাঁধাই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও বই কালোবাজারে যাচ্ছে বলে এনসিটিবির দায়িত্বশীল কেউ কেউ সন্দেহ করছেন।

বই কীভাবে কালোবাজারে যায় সে ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা যায়, ছাপাখানা থেকে সরাসরি ট্রাকে করে জেলা পর্যায়ে বই পৌঁছে যাওয়ার কথা। ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া বইগুলোর একটা অংশ জেলায় বইয়ের গুদামে পৌঁছার আগেই ‘অন্য জায়গায়’ চলে যায়। সম্প্রতি বগুড়া থেকে এ ধরনের একটি ট্রাক আটক করা হয়।

বিনামূল্যের পাঠ্যবই কালোবাজারে চলে যাচ্ছে– এমন তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বই খোলাবাজারে বিক্রি ও মজুতকারী চক্রের দুই সদস্যকে আটক করেছে ডিবি। তাদের কাছে রক্ষিত দুই ট্রাক বই জব্দ করা হয়েছে। এর আগে রাজধানীর বাংলাবাজারে অভিযান চালান ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেখানে ৫ হাজার বই জব্দ করা হয়।

গত বৃহস্পতিবার ভোরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ধাতিয়াপাড়া এলাকা থেকে বিনামূল্যে বিতরণের প্রায় ১০ হাজার বই জব্দ করে পুলিশ। এর মধ্যে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির ৯ হাজার বই ছিল। কুড়িগ্রামের রৌমারী থেকে একটি ট্রাকে করে ঢাকায় পাচারকালে বই জব্দ করেছে শেরপুর সদর থানা পুলিশ। এ সময় মাইদুল ইসলাম নামে একজনকে আটক করা হয়। তাঁর বাড়ি রৌমারী উপজেলায়। পাঠ্যবই গোপনে ঢাকায় পাচার করা হচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থা থেকে– এমন তথ্য পেয়ে ধাতিয়াপাড়া গ্রামে অভিযান চালায় পুলিশ। পরে ট্রাক ও বইসহ মাইদুলকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ট্রাকের চালক সজল মিয়া পুলিশকে জানান, কুড়িগ্রামের রৌমারী সি জি জামান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বইগুলো ট্রাকে করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর।

এর আগে ২০ জানুয়ারি রাজধানীর বাংলাবাজারে অভিযান চালিয়ে পাঁচ হাজার বই জব্দ করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে দুটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। ওইদিন অভিযানে বাংলাবাজার বই মার্কেটের দুটি দোকান ও একটি গোডাউনে সরকারি বই পাওয়া যায়।

জানা গেছে, ঢাকার সাভার উপজেলা, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও পার্বত্য তিন জেলার বিভিন্ন উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তারা অতিরিক্ত চাহিদা এনসিটিবিতে জানিয়ে বই নেন। তারা অতিরিক্ত বই কালোবাজারে দেন। এসব বইয়ের চাহিদা থাকে মূলত কিন্ডারগার্টেনগুলোতে। সরকারের বিনামূল্যের বই সহজে পায় না কিন্ডারগার্টেনগুলো। সরকারি-বেসরকারি স্কুলে দেওয়ার পর তাদের বই দেওয়া হয়। বছরের শুরুতেই বই না পাওয়ায় তাদের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। এ জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকরা বিনামূল্যের পাঠ্যবই খোলাবাজার থেকে কিনতে চান। 

কী বলছে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃপক্ষ
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান সমকালকে বলেন, খোলাবাজারে বই বিক্রি করা আইনত দণ্ডনীয়। যারা এসব করছে তাদের চিহ্নিত করতে কাজ করছে এনসিটিবি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব বই কীভাবে খোলাবাজারের যাচ্ছে তা তদন্ত করা হচ্ছে। তাদের ধারণা, একশ্রেণির প্রিন্টার্স প্রতিষ্ঠান ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মিলে বই বাজারে বিক্রি করছেন। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে, কোথা থেকে বিনামূল্যের বই কালোবাজারে গেল।

আরও পড়ুন

×