জনপ্রশাসন সংস্কারে শত সুপারিশ
জ্যেষ্ঠ সচিব পদ না রাখার সুপারিশ
ক্যাডারদের আন্দোলনকে গুরুত্ব, গ্রেড-১ হবে সচিব

লোগো
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০১:২৯ | আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০৯:২৬
পছন্দের আমলাদের খুশি করতে ২০১২ সালে জ্যেষ্ঠ সচিব পদ সৃষ্টি করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদটি বিলুপ্তির সুপারিশ রেখে আজ বুধবার প্রতিবেদন দিতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এতে গ্রেড-১-এর মান সচিব পদমর্যাদায় উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়েছে। ফলে জ্যেষ্ঠ সচিব, সচিব ও গ্রেড-১ মিলে হবে একটি পদ ‘সচিব’।
সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জনপ্রশাসন সংস্কারে প্রতিবেদনে কমিশন শতাধিক সুপারিশ করেছে।
জানা যায়, অষ্টম বেতন কাঠামোয় সচিবদের মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা নির্ধারিত। জ্যেষ্ঠ সচিবদের মূল বেতন রাখা হয়েছিল ৮২ হাজার টাকা। তবে পেনশনে এ টাকা যোগ হয় না। জ্যেষ্ঠ সচিব পদ মূলত সম্মানের। শুরুতে আটটি থাকলেও পরে করা হয় ১২। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, যে কোনো পদে পদোন্নতি মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার জ্যেষ্ঠ সচিব পদের ক্ষেত্রে এ রীতি মানেনি। পদ ছাড়াও পদোন্নতি দিয়েছে। ফলে জ্যেষ্ঠ সচিব বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিতর্কিত হয়েছেন। ঢালাওভাবে জ্যেষ্ঠ সচিব পদোন্নতি রাষ্ট্রের নিয়মের মধ্যে থাকতে পারে না। কোন পদটি জ্যেষ্ঠ সচিবের মর্যাদা পাবে, তা নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। এ জন্যই পদটি বিলুপ্তির প্রস্তাব করা হবে।
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচে মোট কর্মকর্তা ছিলেন ১৯১। তাদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সচিব সুরাইয়া বেগম মেধাতালিকায় ১৭৮তম হয়েও জ্যেষ্ঠ সচিবের পদোন্নতি পান। একই সঙ্গে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, আইএমইডি, পরিসংখ্যান বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রীর সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও পেয়েছিলেন। এর পর অবসরে গিয়ে তথ্য কমিশনার হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন সুরাইয়া। অথচ মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি হলে সুরাইয়া বেগম সচিবও হতে পারতেন না।
এ ছাড়া গ্রেড-১ পদকে সচিব পদ হিসেবে নামকরণের প্রস্তাব রাখা হতে পারে। এতে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের গ্রেড-১ পদগুলোতে সচিব হিসেবে পদোন্নতি পাবেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি কর্মচারী পরিসংখ্যান ২০২৩ অনুযায়ী, মন্ত্রণালয় ও বিভাগে গ্রেড-১-এর আওতায় অনুমোদিত পদ আছে ৯০টি।
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার সমকালকে বলেন, জ্যেষ্ঠ সচিব বিলুপ্তির প্রস্তাব হলে ভালো হবে। কারণ, এ পদ সৃষ্টির পর নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতি হয়নি। অবশ্য জ্যেষ্ঠ সচিব পদ রাখতে হলে ভারত-পাকিস্তানের মতো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। আবদুল আউয়াল আরও বলেন, সংস্কার কমিশন অন্যান্য দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেয়নি। এটা ঠিক হয়নি। বাংলাদেশ তো অন্যান্য দেশ বা পদ্ধতির বাইরে নয়।
ক্যাডারদের আন্দোলনকে গুরুত্ব
অন্যান্য দেশের পদ্ধতিকে গুরুত্ব না দিলেও সংস্কার কমিশন উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ কোটার সুপারিশ রেখেছে। তবে আমলাদের আন্দোলনের কারণে উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতির প্রস্তাব রাখছে না। আর ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের আন্দোলনকে গুরুত্ব দিয়ে ৫০ শতাংশ কোটার সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গত ১৭ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে। সেখানে কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেছিলেন, এখন থেকে উপসচিব ও যুগ্ম সচিবরা পরীক্ষা ছাড়া পদোন্নতি পাবেন না। পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষা নেবে। ৭০ নম্বর না পেলে পদোন্নতি পাবেন না। এ ছাড়া উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ সুপারিশ করা হচ্ছে। বর্তমানে উপসচিব পদে পদোন্নতিতে ৭৫ শতাংশ প্রশাসন ক্যাডারের জন্য সংরক্ষিত; বাকি ২৫ শতাংশ কোটা অন্য ক্যাডারের।
তাঁর এ বক্তব্যে প্রশাসন ক্যাডারের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা উপসচিব পদে কোটা বাতিলের দাবি করেছেন।
মতামত নেয়নি সব ক্যাডারের
কমিশন সব ক্যাডারের সংস্কারকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তবে তাদের মতামত নেওয়া হয়নি। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক মফিজুর রহমান বলেন, কমিশন সিভিল সার্ভিসের প্রত্যেক ক্যাডারের জন্য হয়েছে। অথচ তারা এককভাবে শুধু প্রশাসন ক্যাডারের মত নিয়েছে। অন্যান্য ক্যাডারের মতামত এভাবে নেয়নি। তারা কী প্রস্তাব দেবে জানি না। তবে আমরা আমাদের দাবি উপদেষ্টাদের জানিয়েছি। তারা বলেছেন, আগে সুপারিশ আসুক, এরপর বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত বৈঠক হয়। পরে কমিশনপ্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, জনপ্রশাসন সংস্কার নিয়ে কমিশনের প্রতিবেদনে শতাধিক সুপারিশ থাকছে এবং সেগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব। কাজের কারণে আমাদের প্রতিবেদন গত মাসে দিতে পারিনি। মাঠে গেছি, লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি, জেলা-উপজেলায় কথা বলেছি, অনলাইনে মতামত নিয়েছি। এগুলোর ভিত্তিতে আমরা প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে স্বাক্ষর করব। বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করব।
এ সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান বলেন, প্রতিবেদন জমার পর সেটি হবে পাবলিক ডকুমেন্ট। ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে, সবাই জানবেন। ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে।
জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গত ৩ অক্টোবর আট সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন করে সরকার। এ কমিশনের প্রধান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। পরে কমিশনের সদস্য সংখ্যা আরও তিনজন বাড়ানো হয়।
প্রতিবেদনে ৯০ দিন বেঁধে দিলেও পরে তিন দফা সময় বাড়িয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা হয়। কাজ শেষ হওয়ায় বুধবারই প্রতিবেদন জমা দিচ্ছে কমিশন।
- বিষয় :
- সুপারিশ