ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

অমর একুশে আজ

একুশ ও একটি স্বপ্ন

একুশ ও একটি স্বপ্ন

যতীন সরকার

যতীন সরকার

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০০:৪৬ | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০০:৪৬

প্রতিদিন এখন আগের দিনের চেয়েও বেশি খারাপ বোধ করি। এখন আর কেউ কোনো লেখা চাইলে দিতে পারি না। আশি বছর বয়স পর্যন্ত লেখালেখি করেছি। এর পর আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। বর্তমানে আমার ঊননব্বই চলছে। 

অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা সবসময় সোচ্চার। প্রতিবাদের ভাষা আমাদের বরাবরই ছিল। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে যতটা মনে করতে পারি, গ্রামের স্কুলে পড়তাম তখন। স্কুল থেকে মাইল খানেক দূরে একটা বাজার ছিল, বসুর বাজার। বায়ান্নার গুলি চলার ঘটনা জানতে পেরে আমি টিনের চোঙা নিয়ে সেই বাজারে প্রতিবাদে উপস্থিত হয়েছিলাম। হরতাল ডেকেছিলাম। সাধারণ মানুষেরা আমার, আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে হরতাল করেছিল। তারা বলছিল, আমাদের ছেলেদের আমরা শহরে লেখাপড়া করার জন্য পাঠাই, আর ওরা তাদের গুলি করে মারে। ওরা নাকি আবার ভোট চাইতে আসবে। এদের ভোট দেওয়া দূরের কথা, ভোটের বদলে ঝাঁটা দেওয়া হবে। সাধারণ হাটুরে ভাইয়েরা বলেছিল, আমরা কেউ আজকে হাট করব না, আজ হরতাল। সেদিন হাট উঠে গিয়েছিল।  

এই তো গ্রামের সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের ভাষা। আমি নিজে তখন ছাত্র। ঢাকার ঘটনা যখন বলছিলাম, সবাই আমাকে বিশ্বাস করেছিল। ক্ষিপ্ত ছিল সবাই। সাধারণ মানুষকে রক্ষার জন্য তাদেরই টাকায় কেনা বন্দুক চালিয়ে তাদেরই হত্যা করা হয়েছে, একটি ন্যায্য দাবির পক্ষে দাঁড়ানোর কারণে– এটা কেউ মেনে নিতে পারছিল না। অনেক ক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছিল। সেসব এখন আর মনে নেই। 
ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আমি ছেলেবেলা থেকেই যুক্ত। ১৯৪৮ সালে যখন জিন্নাহ সাহেব বললেন– স্টেট ল্যাংগুয়েজ অব পাকিস্তান ইজ গোয়িং টু বি উর্দু অ্যান্ড নো আদার ল্যাংগুয়েজ, ছাত্ররা নো নো বলে প্রতিবাদ করল, তখন আমার পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা আমাকে ক্রমশ তৈরি করছে। ছাত্রদের ওপর যখন পুলিশের হামলা হলো, আমার নেত্রকোনার  স্কুলের নাইন-টেনের ছেলেরা আমাদের ক্লাসে এসে বলল, জিন্নাহ বলেছেন আমাদের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে। রাষ্ট্রভাষা উর্দু হলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। সব পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে চলে যাবে। আমাদের এর প্রতিবাদ করতে হবে। শুনে স্কুলের ছাত্ররা বের হয়ে এলাম। উত্তরপাড়ার মাঠে সবাই সমবেত হলো। বলা হলো, জিন্নাহকে আমরা জাতির পিতা, কায়েদে আজম বলি, কিন্তু তিনি যে অবস্থা সৃষ্টি করেছেন, এর পর আর তাঁকে কোনোভাবেই জাতির পিতা বলা যায় না।

সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে আলপনা আঁকছেন শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার তোলা- 	ইউসুফ আলী

এসব খেটে খাওয়া ও হাটুরে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া। ছাত্র, ছাত্রনেতা, শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়া এর চেয়ে খুব বেশি আলাদা কিছু ছিল না। তবে ঢাকায় যেমন প্রতিবাদের এই ভাষা আরও নানা মাত্রা ও রূপ পেয়েছিল, দেয়াল লিখনে, পোস্টারে, ওই দূর পাড়াগাঁয়ে তা হয়নি। ঢাকার খবর আমরা বঞ্চিত ছিলাম না। একটু দেরি হলেও খবর পৌঁছাত। তখনও কিছু কিছু কাগজ আসত। একই সঙ্গে অনেক কাগজপত্রই আসত না এবং এখনও তাই। এখন শুধু দুটি পত্রিকা আসে। যা হোক, কোনো পোস্টার-দেয়াল লিখন ছাড়াই বসুর বাজারসহ আরও চার-পাঁচটা বাজারে চোঙা হাতে আমাদের যাওয়া সার্থক হয়েছিল। বসুর বাজারে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে হরতাল পালন করেছিল। 

গ্রামে সেই সময় আলাপ-আলোচনা কিংবা উত্তেজনার খুব বেশি অনুষঙ্গ ছিল না। সবার দুশ্চিন্তার কেন্দ্রে ছিল ‘চা’। চাকে কেউ ভালো চোখে দেখে না তখন। নিকৃষ্ট কোনো নেশাদ্রব্যই মনে করে। মানুষ বলে, মদ খেয়ে মাতালের বদলে চা খেয়ে মানুষ চাতাল হয়ে যাচ্ছে। এই চাতাল যাতে না হওয়া লাগে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এমন সময় বায়ান্নর সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটল। 
ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আমার শহীদ মিনার নির্মাণের স্মৃতি। যতটা মনে পড়ে গ্রামের স্কুলে আমরা শহীদ মিনার তৈরি করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে ছাত্র অবস্থাতেই যখন আমি আঠার মাস জেলে ছিলাম, একুশে ফেব্রুয়ারি এলে বাকশোর ওপর বাকশো সাজিয়ে শহীদ মিনার বানিয়েছে আরও কয়েকজন মিলে, সেখানে যথাসাধ্য ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। আরও কত স্মৃতি। 
ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সারাদেশে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল। যে আন্দোলন পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের রবীন্দ্র বিরোধিতার বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে প্রস্তুত করেছে, নজরুলকে খণ্ডিত করার অপচেষ্টা রুখে দিয়েছে। আমাদের ভাষাকে উচ্চারণে, বর্ণমালায় বিকৃত করার যে অপপ্রয়াস চালিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা। তাদের সেই চেষ্টাও রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এই প্রতিরোধ ও তার ফলাফলের সবই তৈরি হয়েছে ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়। 

প্রকৃত প্রস্তাবে ভাষা আন্দোলন একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনই ক্রমে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। ফলে আমরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করেছিলাম। আমি এখনও প্রগতিশীল নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখি।  

আরও পড়ুন

×