বায়ুদূষণে বিশ্বে দ্বিতীয় বাংলাদেশ, শহরে তৃতীয় ঢাকা

কোলাজ
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৫ | ০১:০৯ | আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৫ | ০৯:৪২
বায়ুদূষণে ২০২৪ সালে দেশ হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। নগর হিসেবে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ নগর ছিল ঢাকা। দেশের নিরিখে বাংলাদেশের পরই আছে পাকিস্তান। আগের বছর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ শীর্ষে ছিল, আর নগর হিসেবে ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। এবার বায়ুদূষণে শীর্ষ দেশটি হলো আফ্রিকার দেশ চাদ। নগর হিসেবে শীর্ষে আছে ভারতের রাজধানী দিল্লি। চাদ, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও কঙ্গোর পরেই তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে ভারত। বাংলাদেশের গড় বায়ুদূষণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশিত মাত্রার চেয়ে ১৫ গুণ।
গতকাল মঙ্গলবার সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন ২০২৪’-এ এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা এই লাইভ আইকিউএয়ারের সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে তথ্য দেয়। ১৩৮টি দেশ ও অঞ্চলের প্রায় ৪০ হাজার নজরদারি স্টেশন থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আইকিউএয়ারের প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান পিএম ২.৫ বা অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপাদান ধরেই এই বায়ুর মান নির্ণয় করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। সেখানে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) উপস্থিতি ছিল ৭৮ মাইক্রোগ্রাম। ২০২৩ সালে তা ছিল ৭৯ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম।
২০২৪ সালে মাত্র সাতটি দেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বাতাসের মানদণ্ড পূরণ করেছে। দেশগুলো হলো– অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, বাহামা, বার্বাডোস, গ্রেনাডা, এস্তোনিয়া ও আইসল্যান্ড। যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার পর বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে লড়াই আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে বলে গবেষকরা সতর্ক করেছেন। ভারতে পিএম ২.৫-এর গড় মাত্রা আগের বছরের তুলনায় প্রতি ঘটনমিটারে ৭ শতাংশ কমে ৫০.৬ মাইক্রোগ্রামে নামলেও বিশ্বের ২০টি সবচেয়ে দূষিত শহরের মধ্যে ১২টিই ভারতের। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শিল্পাঞ্চলীয় শহর বিরনিহাট তালিকার শীর্ষে রয়েছে, যেখানে পিএম ২.৫-এর গড় মাত্রা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১২৮ মাইক্রোগ্রাম।
আইকিউএয়ারের বায়ু মানবিজ্ঞান ব্যবস্থাপক ক্রিস্টি চেস্টার-শ্রোয়েডার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বায়ুদূষণ বাড়িয়ে তুলছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকায় আরও ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী বনাঞ্চলীয় দাবানল দেখা দিয়েছে, যা বায়ুদূষণকে তীব্র করছে।
এদিকে বিশ্বব্যাপী বায়ুর মান নিয়ে একটি অস্পষ্টতা রয়েছে। বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকায়। উন্নয়নশীল অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ও কনস্যুলেট ভবনে স্থাপিত বায়ুমান পর্যবেক্ষণ সেন্সরের ওপর নির্ভর করত। তবে বাজেট সংকটের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর সম্প্রতি এ কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। গত সপ্তাহে সরকারি বায়ুমান পর্যবেক্ষণ ওয়েবসাইট থেকে ১৭ বছরের বেশি সময়ের তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে, যার মধ্যে চাদের তথ্যও ছিল।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের (ইপিআইসি) ক্লিন এয়ার প্রোগ্রামের পরিচালক ক্রিস্টা হসেনকফ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় অন্তত ৩৪টি দেশ দূষণের নির্ভরযোগ্য তথ্য থেকে বঞ্চিত হবে। এটি বিশ্বব্যাপী বায়ুমান পর্যবেক্ষণ কার্যক্রমের জন্য একটি বড় ধাক্কা।
বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত
২০২২ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের দূষিত বাতাসের দেশের তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে ছিল এবং ভারতের অবস্থান ছিল অষ্টম। ওই বছর দেশের বাতাসে পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি ছিল ৬৫ দশমিক ৮। নগর হিসেবে দূষণের দিক থেকে ঢাকার অবস্থান ছিল তৃতীয়। এ নগরের বায়ুতে পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি ছিল ৭৮ মাইক্রোগ্রাম। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ৮০ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম। এ তালিকায় শীর্ষে থাকা নয়াদিল্লির বাতাসে পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি ৯১ দশমিক ৮। ২০২৩ সালে তা ছিল ৯২ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম। অর্থাৎ সর্বোচ্চ দূষিত এ নগরীরও বায়ুর মান কিছুটা উন্নত হয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) দেশের বিভিন্ন শহরের বায়ুদূষণ পরিস্থিতি নিয়ে সার্বক্ষণিক গবেষণা করে। ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ২০২৩ সালের চেয়ে ২০২৪-এ আমরা তেমন কোনো উন্নতি করতে পারিনি। আমরা দেখেছি, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস আগের ৯ বছরের চেয়ে বেশি দূষিত ছিল। চলতি বছরে বায়ুদূষণ আরও বেড়ে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম দীর্ঘদিন ধরে দেশের বায়ুমান নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, পিএম ২.৫ মূলত ধূলিকণা। এটি স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক। কণাগুলো ফুসফুস ও রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে থাকে। দেশের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিষয়ে যারা দায়িত্বে, তাদের এখন অনেক বেশি সজাগ হওয়ার দরকার। নয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক দুর্বিষহ অবস্থা অপেক্ষা করছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফিরোজ খান বলেন, আমাদের নগরসহ পুরো দেশের জন্যই জরুরি ভিত্তিতে বায়ুদূষণরোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব উৎস থেকে দূষণ হচ্ছে, সেখানে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখানোর সময় এসেছে। এখানে কোনো আপসের সুযোগ নেই।
- বিষয় :
- বায়ুদূষণ