ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

বিশেষ

সবচেয়ে বড় ঈদ উপহার

সবচেয়ে বড় ঈদ উপহার

শরিফুল হাসান

শরিফুল হাসান

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৫ | ০১:০৫ | আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৫ | ০৮:৪১

এই ঈদে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় যে উপহারটি পেয়েছে তা হলো প্রবাসী আয়। ঈদুল ফিতর সামনে রেখে রেকর্ড অর্থ পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। কোনো সন্দেহ নেই, ডলার আর রিজার্ভ সংকটের এই বছরগুলোতে বাংলাদেশের জন্য এই রেকর্ড দারুণ এক ঈদ উপহার। 

চলতি মার্চ মাসের প্রথম ২৬ দিনে দেশে ২৯৪ কোটি মার্কিন ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। এর আগে কোনো একক মাসে দেশে এত প্রবাসী আয় আসেনি। প্রবাসী আয়ের যে ধারা, তাতে ঈদের ছুটি শেষে পুরো মাসের তথ্য পেলে হয়তো দেখা যাবে মার্চে প্রবাসী আয় ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। 

অবশ্য শুধু এবার নয়, সব সময় দুই ঈদে প্রবাসী আয় বছরের অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি আসে। সব মিলিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাস প্রবাসীরা দেশে ১ হাজার ৮৪৯ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন, যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। মূলত গত বছরের জানুয়ারি থেকেই প্রবাসী আয় বাড়ছিল, বিশেষ করে গত বছরের এপ্রিল থেকে প্রতি মাসে ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। তবে জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় প্রবাসীরা প্রবাসী আয় পাঠানো বন্ধ করে দিলে ওই মাসে ১৯১ কোটি ডলারে নেমে আসে। এরপর আগস্ট থেকে গত ৯ মাস ধারাবাহিকভাবে প্রবাসী আয় বাড়ছে। বছরওয়ারি হিসাব ধরলে ২০২৪ সালে দেশে মোট প্রায় ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এসেছে, যেটি গত ৫৩ বছরের হিসাবেও রেকর্ড।

প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ঈদের আগে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত বেড়ে ২৫ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি ধরলে রিজার্ভের পরিমাণ হচ্ছে ২ হাজার ২৯ কোটি ডলার। এ ছাড়া ধারাবাহিক প্রবাসী আয়ের কারণে ব্যাংকগুলোয় ডলারের যে সংকট চলছিল, তাও অনেকটা কেটে গেছে।

মূলত এক কোটির বেশি প্রবাসী, যার বেশির ভাগই মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন, তারাই এই প্রবাসী আয় পাঠান। বছরের পর বছর সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) থেকে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এলেও গত এক বছর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে পেছনে ফেলে প্রবাসী আয়ের বড় উৎস হিসেবে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।

অবশ্য ব্যাংকাররা বলছেন, প্রবাসী আয় প্রেরণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, মানিগ্রামসহ বড় প্রতিষ্ঠানগুলো অ্যাগ্রিগেটেড (সমন্বিত) পদ্ধতিতে প্রবাসী আয় সংগ্রহের পর তা প্রেরণ করে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় যে দেশে, সে দেশ থেকে প্রবাসী আয় আসা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে প্রবাসী আয়ের উৎস দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নাম নথিপত্রে লিপিবদ্ধ হচ্ছে।

সরকারি সংস্থা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে বিপুল পরিমাণ কর্মী দেশের বাইরে যাচ্ছেন। ২০২৩ সালে এক বছরেই দেশ থেকে রেকর্ড ১৩ লাখের বেশি কর্মী কাজের সন্ধানে বিদেশে গেছেন। এর আগের বছর ২০২২ সালে বিদেশে গেছেন ১১ লাখের বেশি কর্মী। আর গত বছর ২০২৪ সালে বিদেশে গেছেন ১০ লাখের বেশি কর্মী। সব মিলিয়ে গত ১৫ বছরে প্রায় এক কোটি লোক বিদেশে গেছেন। এসব কর্মীই এখন প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন। 

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো কিংবা মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরে মূলত নির্মাণশ্রমিক, প্লান্টেশন, কৃষি, সেবা বা উৎপাদন খাতে কঠিন সব পরিশ্রমের কাজ করে প্রবাসী আয় পাঠান বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশের শিক্ষিত যে শ্রেণিটি একেবারে বিদেশে চলে যায়, তারা দেশ থেকে সব বিক্রি করে নিয়ে যায়; আরেক দল বিদেশে টাকা পাচার করে সেখানে থাকবে বলে। কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা টাকা পাঠায় মা-মাটি আর স্বজনের জন্য।

এই প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ যে শুধু দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছে তা-ই নয়; ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তিও এখন প্রবাসী আয়। বিএমইটির তথ্য বলছে, চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শীর্ষ ২০ জেলা হলো– কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল, ঢাকা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, ফরিদপুর ও হবিগঞ্জ।

এই জেলাগুলোতে বেড়াতে গেলে ছিমছাম সবুজ গ্রামের ভেতরকার রাস্তাঘাট-বাড়িঘর দেখে মনে হবে বেশ সমৃদ্ধ। এই জেলাগুলোর প্রায় সব বাড়ি থেকেই কেউ না কেউ বিদেশে গিয়ে কাজ করছেন। বিদেশের পাঠানো টাকায় চলে এখানকার গ্রামীণ অর্থনীতি। শুধু যে প্রবাসীদের পরিবারগুলোই এ টাকা ব্যবহার করে তা নয়, এখানকার পুরো অর্থনীতিই সচল রাখে এ প্রবাসী আয়। কৃষি হোক, মৎস্য কিংবা ছোট-বড় বেশির ভাগ উদ্যোগের পেছনেই আছে প্রবাসীদের বিনিয়োগ।

প্রবাসী ভাইবোন এই টাকা পাঠানো অব্যাহত রাখুক! কারণ অর্থনৈতিক মন্দা হোক কিংবা করোনা মহামারি! যুদ্ধ হোক কিংবা দুর্যোগ! বাংলাদেশের যে কোনো সংকটে বড় ভরসার নাম এই প্রবাসী আয়। এক যুগ আগের বিশ্বমন্দার কথা মনে আছে? ২০০৮-০৯ সালের বিশ্বব্যাপী ওই অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশকে কোনো সংকটে পড়তে হয়নি, কারণ ওই প্রবাসী আয়।

করোনা মহামারির মধ্যেও রেকর্ড পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বছর দু্ই আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ডলার ও অর্থনৈতিক সংকটে বাংলাদেশের ভরসা ছিল প্রবাসী আয়। এখনও তাই। তারা প্রবাসী আয় পাঠানো বন্ধ করলে কী হতে পারে, গত বছরের জুলাইতে তা দেখা গেছে। এই যে তারা নিয়মিত ডলারে প্রবাসী আয় পাঠান, সেই অর্থ বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

আসলে ডলার ছাড়া একটা দেশ চলতে পারে না। পৃথিবীর ৯০ শতাংশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেন নিষ্পত্তি হয় ডলারে। এই যে আমাদের জ্বালানি তেল লাগে, বিদেশ থেকে নানা কিছু আমদানি করতে হয়, এর মূল্য পরিশোধ করতে হয় ডলারে। বৈশ্বিক ঋণের ৪০ শতাংশ ইস্যু হয় ডলারে। আন্তর্জাতিক রিজার্ভ কারেন্সি বা ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ’ হিসেবেও ডলারই ব্যবহৃত হয়।

আমরা চাইলে ধান, চাল, মাংস বা সবকিছুর উৎপাদন চেষ্টা করে বাড়াতে পারি, এমনকি চাইলে টাকাও ছাপাতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু একটা ডলার তৈরির ক্ষমতা নেই। আর সে কারণেই আমরা চাই বৈধ পথে ডলার আসুক। আমরা আসলে আমাদের লোকজনকে বিদেশে পাঠাই ডলারের জন্য। এই ডলার ছাড়া চলা যায় না। 

প্রবাসীরা গত বছর ২৭ বিলিয়ন ডলার পাঠালেন। এই অঙ্ক কত বড়? সহজ করে বললে, সারা পৃথিবী মিলে বাংলাদেশকে এখন যে পরিমাণ ঋণ বা অনুদান দিচ্ছে বা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) যে অর্থ আসছে, তার চেয়ে আট থেকে দশ গুণ বেশি এই অর্থ। বাংলাদেশ এখন আর বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল কোনো দেশ নয়। তার কারণ এই প্রবাসী আয়। তবে যে প্রবাসীরা এত কষ্ট করে টাকা পাঠান, তারা কিন্তু যথাযথ সম্মান পান না। উল্টো তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। 

প্রবাসীদের অভিযোগ, বিমানবন্দর থেকে শুরু করে দূতাবাস সবখানেই পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। পাসপোর্ট তৈরি থেকেই শুরু। এর পর দালাল, চাকরির বিষয়ে অসত্য তথ্য, উচ্চমূল্যে ভিসা কেনাবেচা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সরকারি ছাড়পত্রসহ সবখানে সীমাহীন যন্ত্রণা। দেশের আকাশ পার হলে শুরু হয় বিরূপ প্রকৃতি, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন, মালিকদের প্রতারণা, নির্যাতনসহ আরও কত-কী! আবার বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে গেলে কাঙ্ক্ষিত সেবা মেলে না, দেশে ফিরলেও ভোগান্তি।

এসব সমস্যার সমাধান জরুরি। শুধু প্রবাসী নয়, দেশে থাকা তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্যও উদ্যোগ নিতে হবে। যাতে করে তিনি সম্মানিত বোধ করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, লেখাপড়ায় বৃত্তি, চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিশেষ সুবিধাসহ আরও অনেক কিছু ভাবা যেতে পারে। প্রবাসীদের জন্য ব্যাংকগুলো বিশেষ সঞ্চয় স্কিম করতে পারে। এ ছাড়া দেশে-বিদেশে সম্মান জানাতে রাষ্ট্রীয় কিছু উদ্যোগ নেওয়া উচিত যাতে বৈধভাবে তারা প্রবাসী আয় পাঠাতে উৎসাহী হয়।

কোনো সন্দেহ নেই কয়েক বছর ধরে সরকারগুলো প্রবাসীদের জন্য কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে এখনও অনেক পথচলা বাকি। বিশেষ করে প্রবাসীদের দেশে-বিদেশে সেবা দেওয়ার সময় ইতিবাচক মনোভাব দেখানো জরুরি। 

নানা সময়ে প্রবাসীদের ভোটাধিকারের কথা বলা হলেও এখনও সেটি হয়নি। ফলে যথাযথভাবে তাদের গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অথচ এক কোটিরও বেশি প্রবাসী শুধু যে প্রবাসী আয় পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি সচল রাখছেন তা নয়, অনেক দূর থেকেও বুকের মধ্যে যত্ন করে রেখেছেন লাল-সবুজের জন্য ভালোবাসা। তাদের সবাইকে ঈদ মোবারক। 

শরিফুল হাসান : কলাম লেখক ও বিশ্লেষক

আরও পড়ুন

×