ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

বর্ষবরণে ‘মঙ্গল’ বাদ দিয়ে আনন্দ শোভাযাত্রা

বর্ষবরণে ‘মঙ্গল’  বাদ দিয়ে আনন্দ শোভাযাত্রা

পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে চলছে শোভাযাত্রার প্রস্তুতি। তৈরি করা হচ্ছে রঙিন মুখোশ, মাটির সরা। আঁকা হয়েছে নানা ধরনের পটচিত্রও। সেসব দেখতে ভিড় করছেন নানা শ্রেণি- পেশার মানুষ। শুক্রবার দুপুরে তোলা -মাহবুব হোসেন নবীন

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:২১

বিশাল আকৃতির দাঁতালো ও শিংযুক্ত বাঁশ-কাঠের ওপর কাগজের প্রলেপ বসিয়ে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে ফ্যাসিস্টের প্রতিকৃতি। এ রকম আরও অনেক ছোট-বড় আকৃতির মোটিফকে চূড়ান্ত রূপ দিতে চলছে শেষ সময়ের কাজ। নানা আকারের মুখোশ, মাটির সরায় রঙের আঁচড় বসাতে ব্যস্ত চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তবে বিগত বছরগুলো থেকে এবারের শোভাযাত্রার প্রস্তুতির রং যেন কিছুটা ফিকে। চারুকলা প্রাঙ্গণে নেই সেই চিরচেনা জমজমাট কর্মযজ্ঞ ও প্রাণের উচ্ছ্বাস। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর প্রথম নববর্ষ আয়োজনে বদলে গেছে মঙ্গল শোভাযাত্রার নামও। নতুন নামকরণ হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। 

তবে এই বর্ষবরণের নাম পরিবর্তনের পর সারাদেশে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সবখানে এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে এক সংবাদ সম্মেলনে শোভাযাত্রার নতুন নাম ঘোষণা করেন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলাম শেখ চঞ্চল। 

মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস
মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম শুরু হয় ১৯৮৫ সালের পহেলা বৈশাখে যশোরে, সামরিক শাসনের সময়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের লোকজ সংস্কৃতি তুলে ধরে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শুভশক্তির আগমনের প্রার্থনা করা হয়। চারুশিল্পী মাহবুব জামাল শামীম ছিলেন এর প্রধান উদ্যোক্তা। পরে ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে এটি ঢাকায় শুরু হয়, তখন এর নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। 

শোভাযাত্রার মূলভাব ছিল অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সবাইকে একত্র করার চেষ্টা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা এ শোভাযাত্রার মূল আয়োজক ছিলেন। শিক্ষকদের সহায়তা থাকলেও উদ্যোগ ছিল মূলত শিক্ষার্থীদের। বর্তমানে মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠিত এক অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক আয়োজনে পরিণত হয়েছে, যেখানে সব শ্রেণির মানুষ অংশগ্রহণ করে।
২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো।

শোভাযাত্রার সামনে নিরাপত্তা বাহিনীর বহর থাকবে না
সংবাদ সম্মেলনে চারুকলা অনুষদের ডিন বলেন, আগেও পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে যে শোভাযাত্রাটি বের হতো, সেটির নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। সেটি পরে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়েছিল। এ বছর আবারও আনন্দ শোভাযাত্রায় ফিরে গেলাম। এটিকে পুনরুদ্ধার বলা যেতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্যে দুটি বার্তা আছে। একটি হচ্ছে বিবর্তনমূলক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার অবসান, অন্যটি রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তনমূলক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ, সে বিষয়টি তুলে ধরা। দ্বিতীয় যে অংশটি আছে সেটি হচ্ছে মূলত ঐক্যের ডাক ও সম্প্রীতির ডাক।
সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয়, এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য হলো– ‘নববর্ষের ঐক্যতান, ফ্যাসিবাদের অবসান।’ শোভাযাত্রায় বিশাল আকৃতির মোটিফ থাকবে ছয়টি। সেগুলো হলো– দাঁতালো ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি, কাঠের বাঘ, ইলিশ মাছ, তরমুজের ফালি, ৩৬ জুলাই টাইপোগ্রাফি, শান্তির পায়রা, পালকি, মুগ্ধর পানির বোতল। মাঝারি মোটিফে স্থান পেয়েছে ১০টি সুলতানি ও মুঘল আমলের মুখোশ, ২০টি রঙিন চরকি, ৮টি তাল পাতার সেপাই, ৫টি তুহিন পাখি, ৪টি পাখা, ২০টি ঘোড়া ও লোকজ চিত্রাবলির ১০০ ফুটের ক্যানভাস। 

বিশেষভাবে এবারের আনন্দ শোভাযাত্রায় যুক্ত হয়েছে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন। সেই জায়গাকে তুলে ধরার জন্য অন্যান্য মোটিফের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মুসলমানদের লড়াই ও সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে তাদের প্রতীক হিসেবে তরমুজের মোটিফ সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। এ ছাড়া বৈশাখের দ্বিতীয় দিন চারুকলার বকুলতলায় রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হবে। চৈত্রসংক্রান্তিতে চারুকলা পরিবার আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলবে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। এবারের বর্ষবরণ আয়োজনে ২৮টি জনগোষ্ঠী অংশগ্রহণ করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ জানান, সকাল ৯টায় চারুকলা ও পাবলিক লাইব্রেরির সামনে থেকে শোভাযাত্রা শুরু হবে। বিগত বর্ষবরণের মতো শোভাযাত্রার সামনে নিরাপত্তা বাহিনীর বহর সামনে থাকবে না। থাকবে শোভাযাত্রার দু’পাশে। 

বর্ষবরণ ঘিরে নানা বিতর্ক 
জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রথম বর্ষবরণ হতে যাচ্ছে এটি। এই বর্ষবরণের মূল আকর্ষণ নানা রঙের মিশেলের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই ‘মঙ্গল’ নাম ও পরিবর্তন ঘিরে শুরু হয়েছে বিতর্কের সূত্রপাত। গত ২৩ মার্চ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। নাম পরিবর্তনের বিষয়ে সমালোচনা শুরু হওয়ার পরদিনই তিনি বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। 
এর পর গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা বলেন, শোভাযাত্রার নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা থাকবে কিনা, তা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে তিনি চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রাকে শুধু ‘শোভাযাত্রা’ বলেছেন একাধিক সংবাদ সম্মেলনে। 
অন্যদিকে, ধারাবাহিকতা অনুযায়ী প্রতিবছর মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনে সুনির্দিষ্ট ব্যাচের শিক্ষার্থী ও সব শিক্ষকের অংশগ্রহণ থাকে। এর বাইরেও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আয়োজনের প্রস্তুতিতে শামিল এবং বিভিন্ন শিল্পকর্ম বিক্রির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এবারই ঘটেছে ব্যতিক্রম। ২৬তম ব্যাচকে পাশ কাটানোয় গত ২৬ মার্চ এক বিবৃতির মাধ্যমে এবারের শোভাযাত্রা বর্জনের ঘোষণা দেয় তারা। 

গতকাল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন বিষয়ে এ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা চারুকলা, চারুশিল্পীদের, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যে কোনো ভাব প্রকাশের একটা পথ ছিল। এ মাধ্যমকে খুব বাজেভাবে নষ্ট করা হচ্ছে। আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রার বদলে আনন্দ শোভাযাত্রার সঙ্গে সংহতি জানাতে পারছি না। 
এবারের শোভাযাত্রায় আবু সাঈদের মোটিফ তৈরি নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। পরে সমালোচনার মুখে সেটি বাদ দেওয়া হয়।

নাম পরিবর্তনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও একুশে পদকে সম্মানীত শিল্পী হামিদুজ্জামান খান মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কো ঘোষিত স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি আয়োজন। এর ওপর হস্তক্ষেপ করা ঠিক হয়েছে বলে আমি মনে করি না। এ অনুষ্ঠান চারুকলার ছাত্র-শিক্ষকরা মূলত নিজেদের অর্থায়নে পরিচালিত করে থাকে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আসায় এর ওপর এককভাবে হস্তক্ষেপের অধিকার বোধহয় আমাদের নেই। 

সমাজ, নারী ও পরিবেশবাদী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ খুশী কবির বলেন, এই নাম বদলের কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমরা সবাই এই শোভাযাত্রার নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে গ্রহণ করেছি। বর্ষবরণের অনুষঙ্গ হিসেবে এই শোভাযাত্রার সামগ্রিক লক্ষ্য, আদর্শ রক্ষায় নাম পরিবর্তনে মঙ্গল শব্দটি অপসারণের কোনো কারণ দেখছি না। 
তিনি আরও বলেন, রমনায় ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এবং চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা কোনোটিরই উদ্যোক্তা সরকার নয়। দুটিই কিন্তু তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে এসেছিল। এখানে কোনো ধরনের প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করি।

মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রারম্ভিক অভিযাত্রার অন্যতম পুরোধা শিল্পী সালাহ মাহমুদ বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা শুধু আনন্দের প্রকাশ নয়; আনন্দ এ শোভাযাত্রার অভিব্যক্তি। এর বাইরে মঙ্গল শোভাযাত্রা সমস্ত অশুভ, অসুন্দরের বিপরীতে শুভ, সুন্দর ও মঙ্গলের সমাবেশ। আনন্দ শোভাযাত্রার নাম মঙ্গল শোভাযাত্রায় বদলে গিয়ে এ উদ্যোগকে মূলত আরও ব্যাপক করে তুলেছিল। 
তিনি বলেন, লোকজ মোটিফের বাইরে কখনও সখনও প্রাসঙ্গিকভাবেই অশুভ শক্তির দানবীয় চরিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। তা কোনো ব্যক্তির নয়। এর আগে একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠীর প্রতীকী প্রতিমূর্তি তৈরি হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে নয়, বরং বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ, অশুভ শক্তি হিসেবে। ওটাকে আপত্তিকর ঘোষণা করে অনেকে এখন যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে সাফাই গাইছে। এটি দুরভিসন্ধিমূলক ও ভয়ংকর। একজন উপদেষ্টা খালেদা জিয়ার অন্য মিছিলের ছবিকে মঙ্গল শোভাযাত্রার ছবি বলে মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। 
মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রথম পোস্টার আঁকিয়ে ও বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী শিল্পনির্দেশক, পরিচালক তরুণ ঘোষ বলেন, এই পরিবর্তনের সঙ্গে আমজনতার কোনো সম্পর্ক নেই। বৈশাখ চিরায়ত, বৈশাখ চলমান। কেউ কোনোভাবে পথ রুখতে চাইলে কিছুকাল হয়তো সফল হবে; তবে বারবার বৈশাখ তার পথে ফিরে যাবে। নাম পরিবর্তনে বৈশাখ উদযাপনে ও বাঙালি নববর্ষ উদযাপনের আদর্শকে ধারণে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে বলে মনে করি না।
চিত্রশিল্পী তৈয়বা বেগম লিপি বলেন, এ ধরনের নাম পরিবর্তন অর্থহীন। এসব আগেও হয়েছে। এখনও যদি হয়, বিব্রতকর। মঙ্গল শোভাযাত্রা সরকারি কোনো এজেন্ডা নয়। ক্ষমতার অর্থহীন অপব্যবহারে এর নাম পরিবর্তনের নৈতিক অধিকার কারও আছে বলে মনে করি না।

 

আরও পড়ুন

×