রডের বদলে বাঁশের চটা, বালুর পরিবর্তে মাটি

.
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:৩১ | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৫ | ০৭:৫৮
ঢাকাসহ সারাদেশে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) ৩৬টি কার্যালয়ে একযোগে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রাস্তা, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার, কাজের গুণগত মান বজায় না রাখা, কাজ না করে বা নামমাত্র কাজ দেখিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে এ অভিযান চালানো হয়। ঢাকায় দুদকের প্রধান কার্যালয়সহ ৩৬টি কার্যালয়ের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট গতকাল মঙ্গলবার একযোগে এ অভিযান পরিচালনা করে।
দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট সূত্রে জানা যায়, অভিযানকালে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলায় একটি বিদ্যালয় ভবন নির্মাণে রডের পরিবর্তে বাঁশের চটা ব্যবহারের প্রমাণ মেলে। কয়েকটি জেলায় সড়ক নির্মাণে নিম্নমানের খোয়া ব্যবহার, বালুর পরিবর্তে মাটি ব্যবহারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া অভিযানকালে প্রকল্প বরাদ্দ, ঠিকাদারদের অর্থ উত্তোলন, অনিয়ম-দুর্নীতিতে সরকারি কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতাসহ নানাদিক খতিয়ে দেখা হয়েছে। এলজিইডির প্রধান কার্যালয় ও সারাদেশে অন্যান্য কার্যালয়ের অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়ে দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথাও বলেন এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের সদস্যরা। কোন কোন অফিস থেকে দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তা টিমের সদস্যরা শিগগির প্রতিবেদন তৈরি করে কমিশনে জমা দেবেন। পরে কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
এলজিইডির প্রধান কার্যালয় ঢাকায় এলজিইডির বাস্তবায়নাধীন বাংলাদেশ সাসটেইনেবল রিকভারি ইমার্জেন্সি অ্যান্ড রেসপন্স প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আগারগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। সেখানে ২০২৪ সালের বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য চট্টগ্রাম বিভাগের ছয় জেলা– ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রকল্প বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ১ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে ১ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা অর্থায়ন করবে বিশ্বব্যাংক। অবশিষ্ট অংশ ব্যয় করবে বাংলাদেশ সরকার। এসব প্রকল্পের কার্যক্রম শুরুর আগেই প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণের অভিযোগ রয়েছে। যেমন স্ট্রিট সোলার লাইট প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ৭২ হাজার টাকা। পরিকল্পনা কমিশনের মতে, যদিও বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনে এসব লাইটের কোনো প্রয়োজনই নেই।
একইভাবে প্রকল্পে ৬০টি মোটরসাইকেলের প্রস্তাব করা হলেও পরিকল্পনা কমিশন তা কমিয়ে ৩৬টি করে। এ ছাড়া ল্যাপটপ, কম্পিউটার, বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণসহ অন্যান্য খাতে যে ব্যয় দেখানো হয়েছে, তা অস্বাভাবিক বলে মনে করছে কমিশন। বিশেষ করে চারটি ল্যাপটপের জন্য মোট ১১ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব অস্বাভাবিক। অভিযানকালে প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ করে দুদক টিম।
গাজীপুর : জেলা সদরের শিংরাতলী থেকে ভবানীপুর পর্যন্ত রাস্তার কাজে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের সত্যতা পাওয়া যায়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তিন হাজার মিটার রাস্তার নির্মাণকাজ ইতোমধ্যে শেষ করেছে।
সেখান থেকে রাস্তায় ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রীর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নির্মাণাধীন বাকি ১ হাজার ১৮৫ মিটার রাস্তা থেকেও নির্মাণসামগ্রীর নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
কুমিল্লা: কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় কাশিনগর ইউনিয়নের যাত্রাপুর থেকে শ্রীপুর ইউপির পারুয়ারা পর্যন্ত ২ দশমিক ৩ কিলোমিটার সড়ক পরিদর্শন করে দুদকের টিম। সড়কটির কার্পেটিংয়ের কাজ গত বছরের ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে মর্মে জানতে পারে। পরিদর্শনকালে টিম সড়কটির কিছু জায়গায় জলাবদ্ধতা, ফিনিশিং সমস্যা, কম পুরুত্বের কার্পেটিং এবং সড়কের দুই পাশের শোল্ডার না থাকার চিত্র দেখতে পায়।
যশোর: বাঘারপাড়া উপজেলার খলশী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণে রডের পরিবর্তে বাঁশের চটা ব্যবহারের সত্যতা পাওয়া গেছে। বিদ্যালয়ের চারতলা ভবনের কাজ শেষ হলেও অন্যান্য কাজ চলমান। তাতে বাঁশের চটা ব্যবহার করা হয়েছে। স্কুল ভবনের উইন্ডো সিলিং ও সেলফ ঢালাইয়ের কাজে রড ব্যবহার, ভবনের ৭ ফুট ১১ ইঞ্চি সেলফের ঢালাই কাজে লং ডিসটেন্সে মাত্র একটি রড এবং শর্ট ডিসটেন্সে মাত্র তিনটি রড ব্যবহার করা হয়েছে মর্মে অভিযানকালে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়।
গোপালগঞ্জ: কাশিয়ানী উপজেলার সিংগা হাইস্কুল থেকে রামদিয়া পর্যন্ত ৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার সড়ক কার্পেটিংয়ে অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতা মেলে। সড়কের কার্পেটিংয়ের মানে ত্রুটি ছিল এবং কিছু অংশ ভেঙে গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েছে।
লক্ষ্মীপুর: কমলনগর উপজেলায় রাস্তা নির্মাণে বালুর পরিবর্তে মাটি এবং নিম্নমানের ইটের খোয়া ও নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করার অভিযোগ আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরেজমিন পরিদর্শনকালে রাস্তার কয়েকটি জায়গা খুঁড়ে ইটের খোয়া, বালি এবং মিশ্রণের নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
বাগেরহাট: মোরেলগঞ্জ উপজেলার কালিখোলা বলভদ্রপুর কালীমন্দির থেকে বালিয়াডাঙ্গা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার ও অনিয়মের অভিযোগ আছে। একই অভিযোগ আছে উপজেলায় এলজিইডি কর্তৃক অন্যান্য সড়ক নির্মাণেও। এর পরিপ্রেক্ষিতে একজন ল্যাব সহকারীসহ ওই সড়ক পরিদর্শন করে বিভিন্ন অংশের পরিমাপ এবং ব্যবহৃত সামগ্রীর গুণগত মান যাচাই করা হয়। এ সময় সড়কে নিম্নমানের খোয়া ব্যবহারের প্রমাণ মেলে।
গাইবান্ধা: স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগ, ফুলছড়ি, গাইবান্ধার বিরুদ্ধে এডিপির বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অভিযানকালে বাস্তবায়িত চারটি প্রকল্প পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনের সময় প্রকল্পগুলোর মধ্যে চৌধুরীপাড়া গণপাঠাগার এবং একতা সংঘের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অন্য একটি প্রকল্পের আংশিক কাজ পাওয়া যায়।
শরীয়তপুর: জাজিরা উপজেলার নাওডোবা ইউনিয়নের সিকদার মার্কেট থেকে আবেদ আলী মুন্সী কান্দি পর্যন্ত সড়ক নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী, বিটুমিন ব্যবহারসহ রাস্তার আস্তরণ উঠে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনফোর্সমেন্ট অভিযানকালে ২ হাজার ৭ মিটার দীর্ঘ সড়কের কয়েকটি স্থানে মাটির কাজে ত্রুটি দেখতে পায়। প্রতিশ্রুত ১৭০ মিটার পাইল সাইডিংয়ের পরিবর্তে সড়কটিতে মাত্র ৫০-৭০ মিটার কাজ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ পুনর্নির্মাণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
আরও অভিযান: গতকাল এলজিইডির চট্টগ্রাম, রাজশাহী, দিনাজপুর ও জামালপুর, উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়, ঢাকার কেরানীগঞ্জ, বরিশালের মুলাদী, বগুড়ার শিবগঞ্জ, কক্সবাজারের রামু, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ, মাগুরার শ্রীপুর, খুলনার বটিয়াঘাটা, কিশোরগঞ্জ সদর, কুড়িগ্রামের উলিপুর, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, নারায়ণগঞ্জের বন্দর, নোয়াখালীর কবিরহাট, নওগাঁ সদর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, পটুয়াখালী সদর, পিরোজপুরের নাজিরপুর, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, রাঙামাটির কাপ্তাই ও ময়মনসিংহের ত্রিশালে অভিযান চালিয়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায়।
দুদক মহাপরিচালক আবদুল্লাহ-আল-জাহিদ সমকালকে বলেন, এনফোর্সমেন্ট টিম শিগগির প্রতিবেদন জমা দেবে। প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী যেসব ক্ষেত্রে মামলা করা দরকার, তা করা হবে। যেসব ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার, সেটা জানানো হবে সংশ্লিষ্ট অফিসকে। একই সঙ্গে দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণসাপেক্ষে কোনো কোনো ঘটনা অনুসন্ধান করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
- বিষয় :
- মাটি