ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য সংস্কারের কথা বলল চীন

উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য সংস্কারের কথা বলল চীন

. ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন

 কূটনৈতিক প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৫ | ০১:৩৩ | আপডেট: ০৯ মে ২০২৫ | ০৭:৪৫

উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। বাংলাদেশ সংকটপূর্ণ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকারসহ সব রাজনৈতিক দল সংস্কারের মাধ্যমে দেশ আধুনিকীকরণের পথ খুঁজছে। এতে বাংলাদেশ যদি সহযোগিতা চায়, চীন তার অভিজ্ঞতা বিনিময় করবে। বৃহস্পতিবার সকালে ‘বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ৫ দশক: নতুন উচ্চতার দিকে যাত্রা’ শীর্ষক এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিস) আয়োজিত সেমিনারে চীনের রাষ্ট্রদূত অতিথি বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

ইয়াও ওয়েন বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগে আমাদের অগ্রাধিকার। আমরা এ সম্পর্ক আরও গভীর করতে চাই। স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও সংস্কারের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, একটি দেশের স্থিতিশীলতা হচ্ছে মৌলিক বিষয়। স্থিতিশীলতা ছাড়া উন্নয়ন অসম্ভব। আর বাংলাদেশ, চীনসহ যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের লক্ষ্য হচ্ছে উন্নয়ন। সব মানুষের কল্যাণে উন্নয়ন প্রয়োজন। সেই সঙ্গে আমাদের চালিকাশক্তি হিসেবে সংস্কার দরকার।

বিস চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত এ এফ এম গাউসুল আজম সরকারের সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। স্বাগত বক্তব্য দেন বিস মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ইফতেখার আনিস। প্রশ্নোত্তর ও উন্মুক্ত পর্বে অর্থনীতিবিদ, সামরিক সাবেক কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও বিশ্লেষকরা অংশ নেন। 

মানবিক করিডোরের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই
রাখাইনে মানবিক করিডোর নিয়ে চীনের অবস্থান জানতে চাইলে ইয়াও ওয়েন বলেন, তথাকথিত মানবিক করিডোরের সঙ্গে চীনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। রাখাইনে সংঘাতে আক্রান্ত মানুষের মানবিক সরবরাহের জন্য উদ্যোগটি জাতিসংঘ নিয়েছিল। আমি জানতে পেরেছি, এতে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও আরাকান আর্মি সম্পৃক্ত। তবে চীন এতে সঙ্গে যুক্ত নয়।

চীনের অবস্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, চীন যে কোনো দেশের সার্বভৌম ও অখণ্ডতায় বিশ্বাসী। আমরা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাই না। চীন আশা করে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধান করবে এবং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এখনও লক্ষ্য অর্জন না হলেও চীন তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে বলে জানান ইয়াও ওয়েন।

আরাকান স্বাধীন করা নিয়ে জামায়াতের মন্তব্যের বিষয়ে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, রাজনৈতিক সংলাপে রাখাইনে তথাকথিত স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা, আমার ধারণা নেই। আপনারা লক্ষ্য করেছেন, এ বিষয়ে জামায়াত একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। সেখানে তারাও বিবৃতির বিষয়ে অস্বীকার করেছে।

তিস্তা প্রকল্প দ্রুত শুরুর প্রত্যাশা 
তিস্তা প্রকল্প প্রসঙ্গে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে সিদ্ধান্ত নেবে, তাতে সম্মান জানাবে চীন। এ প্রকল্প দ্রুত শুরু হওয়ার প্রত্যাশা করছি। তিস্তা প্রকল্পে অংশ নিতে বাংলাদেশ এরই মধ্যে চীনকে স্বাগত জানিয়েছে। আমি বলব, চীন প্রস্তুত। আমরা সহযোগিতার প্রস্তাব করতে চাই। তবে দ্বিপক্ষীয়, ত্রিপক্ষীয়, নাকি আন্তর্জাতিক জোটের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে– সে সিদ্ধান্ত একান্তই বাংলাদেশের।

বাংলাদেশের উচিত বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকা 
ইয়াও ওয়েন বলেন, কোনো দেশই অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সব রাষ্ট্রেরই সামাজিক ব্যবস্থা ও উন্নয়নের পথ স্বাধীনভাবে বেছে নেওয়ার অধিকার রয়েছে। চীন ও বাংলাদেশ সব সময় একে অপরকে সম্মান করে এসেছে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অবশ্যই বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকা উচিত। বাংলাদেশের জনগণ তাদের উন্নয়নের পথ নিজেরাই নির্ধারণ করার অধিকার রাখে।

রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় মর্যাদা রক্ষায় এবং এ দেশের নিজস্ব বাস্তবতাভিত্তিক আধুনিকায়নের পথে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে চীন সব সময় ধারাবাহিক ও দৃঢ় সমর্থন দিয়ে আসছে। বিনিময়ে বাংলাদেশও অবিচলভাবে ‘এক চীন নীতি’ অটলভাবে সমর্থন করেছে, তথাকথিত ‘তাইওয়ান স্বাধীনতা’ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে দৃঢ় থেকেছে।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অস্থিরতা এবং বাংলাদেশে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যেও চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক স্থিতিশীল ছিল এবং এর মাধ্যমে এ সম্পর্ক আরও জোরদার হয়েছে। এর মূল রহস্য সমতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। এই নীতি আমাদের ভবিষ্যতের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও অটুট থাকবে।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশ্বাস
দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সংযোগ রক্ষায় এবং রোহিঙ্গা সংকটসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে চীন। এ ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চীনের আগ্রহের কথাও জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত। এ সময় বাংলাদেশসহ অন্যান্য অংশীদারের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক বৈশ্বিক অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি। মুক্ত বাণিজ্য ও বহুপাক্ষিকতা রক্ষায় তিনি সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।

ইয়াও ওয়েন বলেন, এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর বৈধ অধিকার রক্ষায় চীন অঙ্গীকারবদ্ধ। ভবিষ্যতে নিজ নিজ জাতীয় উন্নয়নের পথে পাশাপাশি হাঁটবে চীন ও বাংলাদেশ। দুই দেশের নেতাদের মধ্যে যেসব ঐকমত্য হয়েছে, তা অনুসরণ করে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী থেকে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করতে চায়।

শুল্ক আরোপের সমাধান আপসে হবে না
রাষ্ট্রদূত বলেন, বিভিন্ন দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা শুল্ক আরোপের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ শুল্ক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করছে। চীন মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপসের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হবে না। বরং নীতি, ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচারের প্রতি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে দেশগুলো তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র একাধিক অযৌক্তিক ও একতরফা শুল্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যা বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

চীনের ওপর শুল্ক আরোপের বিষয়ে তিনি বলেন, বৈধ অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার জন্য চীন দৃঢ় ব্যবস্থা নিয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন পক্ষ একাধিক মাধ্যমে শুল্ক এবং সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে সংলাপে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। 

পাকিস্তানে হামলা দুঃখজনক 
সূচনা বক্তব্যে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমে বাড়ছে। বুধবার ভোরে পাকিস্তানে সামরিক হামলা চালায় ভারত। চীন এটিকে দুঃখজনক মনে করে। চলমান এ পরিস্থিতি উদ্বেগেরও।

তিনি বলেন, ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের প্রতিবেশী। তারা উভয়ে চীনেরও প্রতিবেশী। চীন সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানায়। শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে চীন উভয় পক্ষকে সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানাচ্ছে।

ইয়াও ওয়েন বলেন, বিশ্ব আজ অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি যেদিকেই যাক না কেন, চীন ইতিহাসের সঠিক দিকে এবং মানব অগ্রগতির পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। সেই সঙ্গে বিশ্বের স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ শক্তি হিসেবে কাজ করবে।

 

আরও পড়ুন

×