ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

খিলখিল কাজীর স্মৃতিচারণ

দাদুর সঙ্গে কাটানো স্মৃতি ভোলার নয়

নজরুলের জন্মবার্ষিকী

দাদুর সঙ্গে কাটানো স্মৃতি ভোলার নয়

১৯৬৯ সালে কলকাতার বাড়িতে কাজী নজরুল ইসলাম। পাশে নাতনি খিলখিল সংগৃহীত

খিলখিল কাজী

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫ | ০১:২১ | আপডেট: ২৫ মে ২০২৫ | ১০:৪৮

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী আজ। দাদুর সঙ্গে কাটানো দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর নাতনি,  খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী ও নজরুল গবেষক খিলখিল কাজী

জ্যৈষ্ঠ মাস এলেই দাদুর কথা মনে পড়ে। এর কারণ, তাঁর সঙ্গে কয়েকটা জন্মদিন আমি কাটিয়েছি। জন্মদিনে দাদু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হাসিখুশি থাকতেন। আজ সেসব দিনের কথাই বলছি।

আমরা তখন কলকাতায় থাকতাম। দাদুর জন্মদিনে আমাদের বাড়িতে গুণীজন আসতেন। সব শুভানুধ্যায়ীর হাতে থাকত উপহারের ফুল। মা দাদুকে সুন্দর করে সাজিয়ে বসার ঘরে এনে রাখতেন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে। আগতদের দেওয়া ফুলে ফুলে ঘরটা ভরে যেত। আমরা যারা নাতি-নাতনি, আমাদের কাজ ছিল দাদুর গলায় যে মালা দেওয়া হতো, সেটি খুলে পাশে রাখা। শিল্পীরা একে একে আসতেন। তাদের সামনে রাখা হারমোনিয়াম, তবলা নিয়ে গান গাইতেন। সেই গান শুনে দাদু এত খুশি হতেন যে দেখে মনে হতো, তিনি কথা বলতে পারেন। তখন বোঝাই যেত না, তিনি আদৌ কথা বলতে পারেন না। মুখ দিয়ে বিড়বিড় আওয়াজ করতেন। গান শুনে খুব আনন্দিত হলে খিলখিল করে হাসতেন। যিনি গান গাইতেন, তাঁর হারমোনিয়ামের দিকে হাত বুলিয়ে বোঝাতেন– তুমি থেমো না, গান চালিয়ে যাও।

এত ফুল, গান ও কবিতা কখনও আর শুনতে পাব না। তখন অনেক ছোট ছিলাম। মনে আছে, কী অপূর্ব ছিল সেই জন্মদিন! এসব সোনার স্মৃতি! কখনও ভোলার নয়!

মাত্র ২৩ থেকে ২৪ বছর পেয়েছিলেন সৃষ্টিকাল। এতটুকু সময়ের মধ্যে সাড়ে চার হাজারের বেশি গান রচনা করেছেন। এত গান এত অল্প সময়ে আর কোনো কবি সৃষ্টি করেননি পৃথিবীতে। ওই সময়ে যদি তাঁর স্বর স্তব্ধ না হতো, তাহলে আরও অনেক কিছু পেতাম আমরা। তিনি যা দিয়ে গেছেন, সেগুলো নিয়েই আছি আমরা। তাঁর লেখা নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে; যেমন দেশে, তেমনি বিদেশে।

সাহিত্যের এক নতুন দিক উন্মোচন করেছিলেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। মানুষের প্রাণে যে বিদ্রোহ ছিল, সেটি তিনি আরও জাগ্রত করেছিলেন এই কবিতার মধ্য দিয়ে। নিজ লেখনীতে সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কথা বলতেন। আরও লিখতে পারলে এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক চেহারা বদলে যেত।

দাদুর একটি খাতা ছিল আমাদের কাছে। সেই খাতা আমরা প্রায়ই জাদুঘরে দিতাম। সেটির প্রদর্শনী হতো। এখন ওই খাতা নজরুল ইনস্টিটিউটে আছে।

দাদুর এবারের জন্মদিন পরিবারের কাছে বেশি আনন্দের। কারণ, তাঁকে জাতীয় কবি হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমি এ বিষয় নিয়ে অনেক বছর ধরে কাজ করেছি। প্রতিবছর দাদুর জন্মদিন এলে আগে সরকারের কাছে আবেদন করতাম, সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হোক। সেটি শেষ পর্যন্ত এই সরকারের আমলে হয়েছে। তিনি আমাদের মনেপ্রাণে তো ছিলেনই, এবার জায়গাটা আরও শক্তপোক্ত হলো। 

দাদুর জন্মদিন সারাদেশে ও জাতীয় পর্যায়ে উদযাপন হলেও পারিবারিকভাবে আয়োজন থাকে না। শুধু কবর জিয়ারত করা ও গরিবদের খাইয়ে থাকি আমরা। তা ছাড়া সেদিন পরিবারের সবাই ব্যস্ত থাকি নানা অনুষ্ঠানে। সামনের বছর থেকে পারিবারিকভাবে দাদুর জন্মদিন পালন করার চিন্তা রয়েছে।

লেখাটা শেষ করছি একটা আক্ষেপ দিয়ে। আমাদের পরিবারের একটা দুঃখ আছে। ৪২ বছর বয়সে কেন দাদুর কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল? হঠাৎ করে কেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন? এই প্রশ্নটা আগেও ছিল। এখনও আছে।

অনুলিখন দ্রোহী তারা

আরও পড়ুন

×