মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে আগ্রহ হারাচ্ছেন খামারিরা

কোলাজ
জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৫ | ১০:১০
পোলট্রি শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ উপখাত– ব্রিডার খামার ও হ্যাচারিগুলো বড় সংকটে পড়েছে। এক দিন বয়সী ব্রয়লার, লেয়ার এবং কালার জাতের মুরগির বাচ্চার লাগাতার দর পতনের ফলে হাজার হাজার খামার ও হ্যাচারি এখন আর্থিক ক্ষতির মুখে। এই খাতে গত দুই মাসে ৫৩০ কোটি টাকারও বেশি লোকসান হয়েছে বলে দাবি করেছেন খামারিরা।
খামার মালিকরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে দুই-তিন ভাগ কম দামে বাচ্চা বিক্রি করতে হচ্ছে, অথচ উৎপাদন খরচ দিন দিন বাড়ছে। এখনই সরকার কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পোলট্রি শিল্পের মূল ভিত্তি ভেঙে পড়তে পারে। যার প্রভাব পড়বে ডিম ও মাংসের বাজারে। হুমকির মুখে পড়তে পারে দেশের সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তা।
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি) জানিয়েছে, গত এপ্রিল ও মে মাসে ব্রয়লার বাচ্চা গড়ে বিক্রি হয়েছে ৩০-৪০ টাকা, যা মে মাসের শেষে নেমে এসেছে ৮-১০ টাকায়। অথচ সরকার নির্ধারিত খুচরা মূল্য ছিল ৫৮ টাকা। লেয়ার বাচ্চার দাম ছিল গড়ে ৪৭ টাকা, যেখানে সরকার নির্ধারণ করেছে ৫৭ টাকা। কালার জাতের বাচ্চার দাম ছিল ১৫-২০ টাকা, যা উৎপাদন খরচের অর্ধেকেরও কম।
এ পরিস্থিতিকে ‘মারাত্মক ও পূর্বাভাসহীন ধস’ বলে উল্লেখ করেছেন ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সভাপতি মাহাবুবুর রহমান। তিনি বলেন, বর্তমানে যে হারে বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে, তাতে প্রতি সপ্তাহে আমাদের কয়েক কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। দুই মাসে শুধু ব্রয়লার বাচ্চাতেই লোকসান হয়েছে প্রায় ৫৩০ কোটি টাকা। এটা আর শুধু ব্যবসায়িক সমস্যা নয়, কৃষিভিত্তিক শিল্পের জন্য বড় হুমকি। এ ছাড়া গত বছরের জুন-অক্টোবরেও হিটস্ট্রোক, অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে খাতটি লোকসান গুনেছে প্রায় ৪১৭ কোটি টাকা।
সংকটে পড়ে জয়পুরহাট, নওগাঁ, কুমিল্লা, গাজীপুরসহ দেশের নানা প্রান্তে ছোট ও মাঝারি খামারিরা তাদের খামার বন্ধ করে দিচ্ছেন। কারণ, বাচ্চা কম দামে কিনলেও পরে বিক্রি করে লাভ করা তো দূরের কথা, মূলধনও মিলছে না। শুধু জয়পুরহাটেই গত তিন মাসে বন্ধ হয়েছে ১২০টির বেশি ছোট খামার।
পোলট্রি শিল্পে এগিয়ে থাকা জেলা জয়পুরহাটে এক দিনের মুরগির বাচ্চার দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কমে গেছে। প্রতিটি বাচ্চা দুই থেকে আড়াই ভাগ কম দামে বিক্রি হচ্ছে। হ্যাচারি মালিকরা বলেছেন, এক দিনের মুরগির বাচ্চার দামের এই ধসের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। কয়েক বছর ধরেই লোকসানে পড়ে ছোট খামারগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বাচ্চার উৎপাদন বাড়লেও চাহিদা কমেছে। এ ছাড়া প্রচণ্ড গরমের কারণে বাচ্চা মারা যাওয়ার ঝুঁকি থাকায় অনেক খামারি বাচ্চা কিনছেন না।
খামারিদের মতে, ব্রিডার খামার ও হ্যাচারি হলো দেশের ডিম ও মাংস উৎপাদনের প্রথম ধাপ। এগুলো ভেঙে পড়লে পুরো পোলট্রি চেইনে ধাক্কা লাগবে। টাঙ্গাইলের হ্যাচারি মালিক মিজানুর রহমান বলেন, একটা হ্যাচারি বন্ধ হলে শুধু মালিক নয়, তার অধীন শতাধিক খামার, শ্রমিক, সরবরাহকারী– সবাই বিপদে পড়ে। এই বাস্তবতা বুঝতে হবে নীতিনির্ধারকদের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে বাচ্চার উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে, কিন্তু বাজারে সমপরিমাণ চাহিদা বাড়েনি। তার ওপর রয়েছে গ্রীষ্মকালীন তাপপ্রবাহ ও রোগবালাইয়ের ভয় তো। ফলে খামারিরা নতুন বাচ্চা তুলতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
প্রাণিসম্পদ গবেষক ড. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বাচ্চা উৎপাদন ও ডিম-মাংসের চাহিদার মধ্যে সমন্বয় না ঘটালে এ ধস আরও গভীর হবে। বাংলাদেশে পোলট্রি শিল্প শুধু খাদ্য নিরাপত্তার বিষয় নয়, এটি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। ডিম, মুরগির মাংসের মতো প্রোটিন উৎস সাশ্রয়ী দামে রাখতে হলে, এই শিল্পের ভিত্তি– ব্রিডার ও হ্যাচারিকে রক্ষা করা জরুরি। সরকার যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে সামনে আরও ভয়াবহ সংকট অপেক্ষা করছে।
২০২৩ সালে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ব্রয়লার বাচ্চার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করেছিল ৫৩ টাকা। গত এপ্রিলে ব্রিডার ও হ্যাচারি মালিকরা মূল্য সমন্বয়ের প্রস্তাব দিয়ে ব্রয়লার বাচ্চার দাম ৬০ টাকা এবং লেয়ার বাচ্চার দাম ৬৫ টাকা (ভ্যাকসিন ছাড়া) নির্ধারণের দাবি জানায়। তবে এখন পর্যন্ত সেই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয়নি। এ পরিস্থিতিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টদের জরুরি হস্তক্ষেপ চেয়ে গত ১৮ মে ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকে (বিএবি) চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে অংশীজন নিয়ে সমন্বয় সভা করার আহ্বানও জানিয়েছে সংগঠনটি।
এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবু সুফিয়ান বলেন, মুরগির বাজার ভালো থাকলে খামারিদের চাহিদাও বেশি থাকে। এখন বাজার পড়ে যাওয়ায় চাহিদা কমেছে। তবে মুরগির বাচ্চার এ দাম স্থায়ী হবে না। আমরা বিষয়টি নিয়ে দ্রুত সভা করব।
- বিষয় :
- মুরগি