উদ্ভিদ
দেশেই আছে রূপসী অর্কিড

গুলশান ঝিলপাড়ের উদ্যানে ফুটেছে রূপসী অর্কিড শিয়াল লেজার ফুল -লেখক
মৃত্যুঞ্জয় রায়
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫ | ০১:১২ | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৫ | ০৮:১৫
গ্রীষ্মের এক জলভেজা ও রোদ ওঠা সকাল। মাঝে মাঝে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হচ্ছে। আবার মেঘ সরে গিয়ে রোদ উঠছে। গুলশানে সৌদি আরব দূতাবাসের পশ্চিম পাশের সড়ক ডিঙিয়ে ঢুকে পড়লাম ঝিলপাড়ের উদ্যানে। একটা ফোয়ারা আকাশের দিকে জল ছুড়ছে। পাড়ে একটা তরুণ হিজল গাছ তখনও ফুল ঝরাচ্ছে। উদ্যানের ভেতরে কলাবতীর মতো কয়েকটা হেলিকোনিয়া রোজট্রাটা (Heliconia rostrata) গাছে বেণীর মতো ঝুলছে লাল-হলদে ফুলের মঞ্জরি। হেঁটে খানিকটা সামনে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল এক রূপসী অর্কিডের। ঘন ঝোপ হয়ে রয়েছে। সেখানে আলো করে লম্বা মালার মতো দুলছে সেসব ফুলের মঞ্জরি। হেলিকোনিয়াকেও সে হার মানিয়েছে।
কাছে যেতেই অসংখ্য বেগুনি-সাদা ফুলভরা শিয়ালের লেজের মতো ফুলের মঞ্জরিগুলো যেন হেসে উঠল। মালার মতো দেখতে। এজন্যই কি এর কেতাবি নাম ধ্রুপদিমালা? যদিও এর ইংরেজি নাম ফক্সটেইল অর্কিড। কেউ কেউ তাই বাংলায় বলেন শিয়াল লেজা অর্কিড।
ব্রিটিশ উদ্ভিদবিদ ও চিকিৎসক জোশেফ ড্যালটন হুকারও সিলেটের খাসিয়া পাহাড়ে উদ্ভিদ অভিযানে গিয়ে এ অর্কিডের দেখা পেয়েছিলেন। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন ১৮৫০ সালের মে-জুন মাসে। তিনি খাসিয়া পাহাড়ের অর্কিড রাজ্য দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন। তাঁর মনে হয়েছিল, সেখানকার অর্কিড সম্ভবত একটি বৃহত্তম উদ্ভিদগোষ্ঠী, প্রজাতি সংখ্যা কমপক্ষে ২৫০। সেখানে তিনি দুই ধরনের অর্কিড দেখতে পেয়েছিলেন। এক রকমের অর্কিড জন্মে শিকড় আঁকড়ে অন্য গাছ বা পাথরের ওপর। এগুলো হলো পরাশ্রয়ী অর্কিড। আরেক ধরনের অর্কিড জন্মে মাটিতে, সেগুলো হলো ভূঁই অর্কিড। এসব অর্কিড সম্পর্কে তিনি তাঁর হিমালয়ান জার্নাল বইয়ে লিখেছেন, ‘পৃথিবীর আর কোথাও অর্কিড প্রজাতি সেখানকার উদ্ভিদ রাজ্যে এতটা জায়গা দখল করতে পেরেছে কিনা আমার সঠিক জানা নেই।’
সত্যিই তাই, সিলেটের খাসিয়া পাহাড়ের মতো অর্কিড বৈচিত্র্য পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। মোহাম্মদ কামরুল হুদা ও কল্লোল তালুকদার বাংলাদেশের নান্দনিক অর্কিড নামে একটি বই লিখেছেন। ২০২৪ সালে প্রকাশিত সে বইটিতে তারা লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে মোট ১৮৮ প্রজাতির অর্কিড জন্মে, যার মধ্যে ১১৭টি প্রজাতি পরাশ্রয়ী ও ৭১টি প্রজাতি ভূঁই অর্কিড।’ এই দেশি অর্কিডও সেগুলোর মধ্যে একটি।
এ অর্কিডের প্রজাতিগত নাম রিনকোস্টাইলিস রেটুসা (Rhynchostylis retusa), গোত্র অর্কিডেসি। এটি একটি বৃক্ষাশ্রয়ী বিরুৎজাতীয় উদ্ভিদ। শিকড়গুলো দেখতে সাদাটে-সবুজ কেঁচোর মতো, আশ্রয়দাতা গাছকে শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরে। কাণ্ড খাড়া হয়ে ওপরের দিকে থাকে। পাতা পুরু, চামড়ার মতো, সবুজ ও লম্বা, মাঝশিরা বরাবর কিছুটা ভাঁজকৃত। ফুলের মঞ্জরি লম্বা ও ঝুলন্ত। মঞ্জরি ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার লম্বা, ফুলগুলো প্রায় ২ সেন্টিমিটার আকারের, পাপড়ি সাদা ও ম্লান গোলাপি।
মে মাসে ফুল ফোটা শুরু হয়; ফুটতে থাকে জুলাই পর্যন্ত। এরপর ফল হয়, ক্যাপসুলের মতো। এই অর্কিড দেশের প্রায় সর্বত্র দেখা যায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমবাগানে, কক্সবাজারে মেহগনি গাছে, এমনকি সুন্দরবনেও পশুর গাছে এর দেখা পেয়েছি। তবে পাহাড়ি অরণ্যে বেশি রয়েছে। বিদেশ থেকে অনেক প্রজাতির সুন্দরী অর্কিড এ দেশে আসায় শিয়াল লেজার মতো দেশি অর্কিডের কদরে কিছুটা ভাটা পড়েছে। আশঙ্কাটা সেখানেই, না জানি দেশি অর্কিডগুলো আবার বিদেশি রূপসিনীদের আকর্ষণে হারিয়ে যায়!
- বিষয় :
- উদ্ভিদ