ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে সবচেয়ে বেশি গুম

আন্দোলন ও নির্বাচনের সময় গুমের ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল : নূর খান লিটন, মানবাধিকারকর্মী

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে সবচেয়ে বেশি গুম

প্রতীকী ছবি

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫ | ০২:০৩ | আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৫ | ১০:৪১

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে দেড় দশকে অনেক মানুষ গুম হয়েছেন। এর মধ্যে সর্বাধিক গুমের ঘটনা ঘটে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের বছর, ২০১৭ সালে। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের অনুসন্ধান করা ২৫৩টি ঘটনার মধ্যে ৫১টিই ছিল ওই বছরের। কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের অনেকেই ছিলেন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে বিএনপি নেতাকর্মী বেশি।

কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন সমকালকে বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে জনগণ পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আন্দোলন করেছে। সেবার নির্বাচনে কারসাজি করে ১৫৩টি আসনের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচন আগের মতো করার সুযোগ ছিল না। এ কারণে ওই সময়ে অনেক বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা ঘটেছে। আন্দোলন ও নির্বাচনের সময় গুমের ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল। এটি স্পষ্ট যে তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা রাখতে চায়নি। 

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে গুমের তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১২ সাল ছাড়া প্রতি বছরই এমন ঘটনা ঘটেছে। কমিশনের তদন্ত করা ঘটনাগুলোর মধ্যে ২০১০ সালে ৪ জন, ২০১১ সালে ২ , ২০১৩ সালে ৩ ও ২০১৪ সালে ৮ জনকে গুম করা হয়। এরপর গুমের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। ২০১৫ সালে ২১, ২০১৬ সালে ৩২ এবং পরের বছর তা সর্বোচ্চ ৫১ হয়। ২০১৮ সালে ৩৭, ২০১৯ সালে ৩৩ ও ২০২০ সালে ১৪ জন গুম হয়। ২০২১ সালে গুমের ঘটনা আবার বেড়ে ১৮ এবং পরের বছর তা ২৪ হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ৬ জনের গুম হওয়ার তথ্য যাচাই করা হয়েছে।  

গুমের শিকার ২৫২ জনের বয়সের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৯ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের গুমের ঘটনা বেশি। ২৭ থেকে ২৮ বছর বয়সীরা সর্বাধিক গুমের শিকার হয়েছেন। অন্তত ১০ জন অপহরণের সময় ১৮ বছরের কম বয়সী বা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন। প্রতিবেদনে বলা হয় সংশ্লিষ্টরা যুক্তি দিতে পারেন যে, অল্পবয়সীদের উগ্রপন্থার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। তবে চরমপন্থাবিরোধী গবেষণা অনুযায়ী, মতাদর্শগত পরিবর্তন সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালের শেষের দিকে শুরু হয়। অথচ গুমের শিকার ব্যক্তির বেশির ভাগের বয়স ২০ বছরের বেশি। এই বয়স রাজনৈতিক পরিপক্বতা এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি ইঙ্গিত করে যে সন্ত্রাসবাদ দমনের চেয়ে রাজনৈতিক হুমকি মোকাবিলার জন্য গুমের ঘটনা বেশি ঘটে থাকতে পারে। আবার বয়সের তথ্যের সঙ্গে বিবেচনা করলে এই ধরনটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গুমের শিকার বেশির ভাগের বয়স ব্যবসা, শিক্ষকতা বা বেসরকারি চাকরির মতো পেশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দেখা যাচ্ছে, ভুক্তভোগীদের একটি বড় অংশ শিক্ষার্থী হলেও তাদের অনেকেই বয়স্ক, স্নাতকোত্তর বা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। এর থেকেও বোঝা যায়, তরুণদের উগ্রপন্থায় জড়ানো রোধের চেয়ে রাজনৈতিক সংগঠনে জড়িত বা জড়াতে সক্ষমদের দমন করার একটি উদ্দেশ্য ছিল।

গুমের শিকার ২২৮ জনের পেশাগত পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ছাত্র ৬৬ জন, ব্যবসায়ী ৬৪, শিক্ষক ৩৪, বেসরকারি চাকরিজীবী ৩৩, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ১০ এবং সাংবাদিক ৫ জন। গুমের ঘটনাগুলোয় এক দিন থেকে শুরু করে পাঁচ বছর পর্যন্ত কেউ কেউ নিখোঁজ ছিলেন। ভুক্তভোগীদের অর্ধেক ৪৭ দিনের কম এবং বাকিদের এর চেয়ে বেশি সময় ধরে আটকে রাখা হয়েছিল।

গুমের শিকার ২৫৩ জনের মধ্যে ১০১ জনের রাজনৈতিক পরিচয় জানা গেছে। তাতে দেখা যায়, বিএনপির ৩৭, ছাত্রশিবিরের ৩১, জামায়াতের ২৫, আওয়ামী লীগের দু’জন, ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলামের দু’জন করে, খেলাফত মজলিশ ও তাবলিগ জামাতের একজন করে গুমের শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ তাদের বেশির ভাগই বিরোধী রাজনৈতিক দলের ছিলেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগে গুমের ঘটনা দুটি দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরোধ অথবা রাজনৈতিক মতবিরোধের সঙ্গে সম্পর্কিত। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে একটি বিষয়ে জোর দেওয়া হতো, তা হলো রাজনৈতিক পরিচয়। বারবার তাদের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হতো। এ থেকে বোঝা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের গুমের ব্যবস্থাটি ছিল স্পষ্টতই রাজনৈতিক এবং প্রয়োজনে অন্যান্য উদ্দেশ্যেও তা ব্যবহার করা হয়।

গত ৪ জুন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: অ্যা স্ট্রাকচারাল ডায়াগনোসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন জমা দেয় গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। এতে ১ হাজার ৮৩৭টি অভিযোগ বিশ্লেষণ করে ২৫৩ জন গুমের শিকার ব্যক্তির তথ্য উপস্থাপন করা হয়।

আরও পড়ুন

×