নেপালের বিদ্যুৎ কেন ভারতীয় কোম্পানির মাধ্যমে কিনবে বাংলাদেশ?

বাংলাদেশ ও ভারতের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রির জন্য নেপালের বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে অনুমোদন দিয়েছে নেপালের সরকার। অনুমোদনের পর বাংলাদেশ সরাসরি নেপাল থেকে নয়, ভারতীয় একটি কোম্পানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেনার ব্যাপারে চুক্তি করেছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, নেপাল থেকে বিদ্যুৎ কিনে বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করবে ভারতীয় একটি কোম্পানি এমন একটি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। খবর বিবিসির

তিনি বলেন, ‘নেপাল এবং জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা বিশাল। এই জলবিদ্যুৎ নেওয়ার জন্যই প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেছেন। আমি নিজে গত বছর গিয়েছিলাম নেপালে এবং সেখানে আমাদের একটা চুক্তি সই হয়েছে।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি, ভারতের জিএমআর কোম্পানির কাছ থেকে নেপালের বিদ্যুৎ নেওয়ার। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সরাসরি চুক্তি হচ্ছে জিএমআরের সাথে যে ওনারা বিদ্যুৎটা আনছেন নেপাল থেকে। তারা সঞ্চালন লাইন তৈরি করবে, আমরা সেখান থেকে বিদ্যুৎ নেব।’

কীভাবে এই বিদ্যুৎ আনা হবে?

নেপালের সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দেশটিতে চাহিদা পূরণের পর যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকবে তা বাংলাদেশ ও ভারতের কাছে বিক্রি করতে পারবে নেপালের বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন কম হলে এই দুটি দেশ থেকে বিদ্যুৎ কিনতেও পারবে।

যে কারণে সরাসরি নেপাল থেকে নয়

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। তবে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা এর অর্ধেকের মতো। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই ভারত থেকে ১৩শ' মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ কিনছে।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলছেন, ‘ভারতের একটি ক্লজের কারণে বাংলাদেশ সেটা পারছে না। বিদ্যুতের আমদানি ব্যবসা ভারত তার একটি পলিসি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে।’

তিনি বলেন, ‘তাদের ক্লজ অনুযায়ী দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতাতেই শুধু বিদ্যুৎ ব্যবসা হতে পারবে। সেই কারণে নেপাল থেকে সরাসরি বিদ্যুৎ নিতে পারার সুবিধাটা বাংলাদেশ পায়নি।’

ভারতের সেভেন সিস্টার নামে পরিচিত রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পণ্য পরিবহনে ভারত ২০১৬ সালে ট্রানজিট সুবিধা পায়। ২০১০ সাল থেকে কয়েক দফায় কোনও ধরনের ফি ছাড়াই আশুগঞ্জ নৌ বন্দর ও আশুগঞ্জ-আখাউড়া প্রায় ৪৫ কিলোমিটার সড়ক ব্যবহার করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভারি মালামাল এবং খাদ্যশস্য ট্রানজিট করেছিল ভারত।

মাত্র দুদিন আগেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্দর ব্যবহারের সুবিধা দেওয়ার ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তির প্রথম ভারতীয় পণ্যের জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে।

ড. শামসুল আলম বলেন, ‘এই জায়গাটায় দর কষাকষির সুযোগ ছিল। আমরা যেসব সুবিধা ভারতকে দিয়েছি পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে, ট্যাক্স টোলের ব্যাপারে, সেই সব সুবিধার বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশের জন্য এই ক্লজ বাতিল করতে পারতো। যে অসম নিয়ন্ত্রণ পলিসি ভারত বিদ্যুৎ আমদানির উপরে আরোপ করেছে, আমি মনে করি বাংলাদেশের এটা নিয়ে কূটনৈতিক লড়াই করা উচিৎ।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য খরচ হয় ২৯ পয়সা। তার মতে নেপাল থেকে বাংলাদেশ সরাসরি সঞ্চালন করে বিদ্যুৎ আনলেও এই জল বিদ্যুতের দাম যথেষ্ট কম থাকবে। তার ভাষায় বাংলাদেশ সেই সুবিধা না নিতে পারলে সেটি হবে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা।’

দাম নিয়ে প্রশ্ন

তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ রক্ষার বিষয়ে বামপন্থীদের একটি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এম আকাশ প্রশ্ন তুলেছেন এভাবে বিদ্যুৎ ক্রয়ে বাংলাদেশের জন্য কতটা লাভজনক হবে সে নিয়ে।

তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ একটা পাবলিক গুডস। বাংলাদেশে এর দাম নিয়ন্ত্রিত হয় পাবলিক রেগুলেটরি কমিশন দ্বারা। এর জন্য গণশুনানি হয়।’

অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ‘নেপালের ইলেক্ট্রিসিটি কোম্পানি পণ্যটি বিক্রি করবে ভারতীয় একটি কোম্পানির কাছে। সেই ভারতীয় ইলেক্ট্রিসিটি কোম্পানি আবার সেই পণ্যটি বিক্রি করবে আমাদের কাছে। সেখানে নিশ্চয়ই মুনাফার বিষয় থাকবে।’

তিনি বলেন, ‘খুব স্বভাবতই এখানে দামের লজিকটা কাজ করবে নেপালের কোম্পানি যে দামে ভারতের কোম্পানির কাছে বিক্রি করবে তারা নিশ্চয়ই আমাদের কাছে আরও বেশি দামে বিক্রি করবে তা না হলে মুনাফা কীভাবে হবে। যেহেতু বাণিজ্যিক লেনদেন হচ্ছে। সেজন্য বিষয়টি মুনাফা ভিত্তিক হয়ে যাবে।’

এর বাইরে দামের সাথে ট্যাক্স ও টোল দিতে হবে। নেপাল ও ভারত থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ আনার জন্য সঞ্চালন ফি সম্ভবত থাকতে পারে। সব মিলিয়ে সরাসরি নেপাল থেকে বিদ্যুৎ না আনতে পারার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য কতটা লাভজনক থাকবে সেই প্রশ্ন তুলছেন অধ্যাপক আকাশ।