ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

বরকত-রুবেলের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষে মামলা করতে যাচ্ছে দুদক

বরকত-রুবেলের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষে মামলা করতে যাচ্ছে দুদক

হকিকত জাহান হকি

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২০ | ১৬:০৮

ফরিদপুরের আলোচিত দুই ভাই সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও মো. ইমতিয়াজ হাসান রুবেলের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুদক। অনুসন্ধানে এ দু'জনের নামে ৭২ কোটি ৮৪ লাখ ৭৯ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটি।

অনুসন্ধান সংশ্নিষ্টরা জানান, জমি দখল ও নামমাত্র মূল্যে কেনা ছিল তাদের বড় নেশা। তারা ৩২৬টি দলিলের বিপরীতে প্রায় ৫০০ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন। প্রভাব খাটিয়ে মাস্তানি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির মাধ্যমে সম্পদ অর্জনে তারা ছিলেন বেপরোয়া।

দুদকের একজন পরিচালক সমকালকে বলেন, বরকতের নামে ৪৪ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার ৮৩২ টাকার এবং রুবেলের নামে ২৮ কোটি ৩৫ লাখ ১০ হাজার ১৭০ টাকার অবৈধ সম্পদ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানকালে তাদের সম্পদের বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। কমিশনের অনুমোদনক্রমে শিগগির তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।

তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগটি অনুসন্ধান করেছেন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আলী আকবর।

দুদক সূত্র জানায়, ফরিদপুর সদরের দুই ভাই বরকত ও রুবেলের ছোট ব্যবসা ও ছোট চাকরি দিয়ে জীবন শুরু হলেও বরকত রাজনীতিতে পা রাখার পর থেকে তাদের জীবন পাল্টে যায়। অর্থসম্পদ বাড়তে থাকে হুহু করে। সাজ্জাদ হোসেন বরকত ফরিদপুর সদর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে রুবেল ছিলেন তার ডান হাত। এলাকার মানুষের কাছে তারা ছিলেন ত্রাস।

জমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অভিযোগে চলতি বছরের জুনে দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করে। বর্তমানে তারা জেলে আছেন। দুদকের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, বরকত ১৯৯২ সালে এসএসসি পাস করার পর এইচএসসি পড়তে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে এইচএসসি পাস করা হয়নি। তার বড় ভাই রফিকুল ইসলাম কুয়েতে চাকরি করতেন। বর্তমানে পৈতৃক বাড়িতে থাকেন। ছোট ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেল স্নাতক পাস করেছেন। সবার ছোট ভাই ইমতিয়াজ হাসান জুয়েল ফরিদপুর কৃষি কলেজে শিক্ষকতা করেন।

বরকত লেখাপড়া বাদ দিয়ে ফরিদপুর শহরে রড-সিমেন্টের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এই ব্যবসার পাশাপাশি ঠিকাদারি কাজ শুরু করেন। পরে ২০১০-১১ সালে তিনি নিজ নামে এস বি ট্রেডার্স নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চালু করেন। পরে এসবিসিইএল, বরকত এগ্রো লিমিটেড ও সাউথ লাইন পরিবহন চালু করেন। ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানে তার নামে থাকা জমির ২২০টি দলিল রয়েছে।

বরকতের অবৈধ সম্পদ

বরকতের আয়কর নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, তিনি ২০১২-১৩ করবর্ষে প্রথম আয়কর নথি খোলেন। তিনি ২০১২-১৩ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষ পর্যন্ত নিয়মিত আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বরকত ২০০৭-০৮ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষ পর্যন্ত নিজ নামে ও স্ত্রীর নামে এবং এস বি কনস্ট্রাকশনের নামে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ঘোষিত সম্পদের মূল্য ৩৯ কোটি ৪৮ লাখ ২৮ হাজার ২৫৮ টাকা। তার সম্পদ বিবরণীতে মোট ৭৫ কোটি ৮৮ লাখ ৮৩ হাজার ৯১০ টাকা মূল্যের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্পদ বিবরণীতে তিনি ৩৬ কোটি ৪০ লাখ ৫৫ হাজার ৬৫২ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি দুদক আইন-২০০৪ এর ২৬(২) ধারায় অপরাধ করেছেন।

তার আয়কর নথি ও দায়দেনা পর্যালোচনা করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে ৩১ কোটি ৩৯ লাখ ১৫ হাজার ৭৮ টাকার আয়ের বৈধ উৎস পাওয়া গেছে। এই হিসাব অনুযায়ী বরকতের নিজের, স্ত্রী ও এস বি কনস্ট্রাকশনের নামে মোট ৪৪ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার ৮৩২ টাকার অবৈধ সম্পদ পাওয়া যায়।

রুবেলের আয়কর নথি

ইমতিয়াজ হাসান রুবেল ২০০১-০২ করবর্ষে প্রথম আয়কর নথি খোলেন। এতে দেখা যায়, তিনি ২০০১-০২ হতে ২০০৬-০৭ করবর্ষ পর্যন্ত তার আয় শূন্যের কোটায়। দেখা যায়, তার ২০০৭-০৮ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষের আয়কর রিটার্নে ৩২ কোটি ৫০ লাখ ৫২ হাজার ৬২৫ টাকার আয় ও পারিবারিক ব্যয়ের পরিমাণ ১৭ কোটি ৭১ লাখ ৭১ হাজার ৮৫৮ টাকা উল্লেখ করেছেন। ব্যয় বাদে নিট আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬৪ হাজার ৩৬৩ টাকা। ব্যাংক ঋণের স্থিতি এক লাখ ৮০ হাজার ১২৬ টাকা। এই হিসাব অনুযায়ী, তার বৈধ আয় ১৪ কোটি এক লাখ ৪৪ হাজার ৪৮৯ টাকা। তার নামে মোট স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ পাওয়া যায় ৪২ কোটি ৩৬ লাখ ৫৪ হাজার ৬৫৯ টাকার।

এই হিসাব অনুযায়ী, রুবেলের নামে ২৮ কোটি ৩৫ লাখ ১০ হাজার ১৭০ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পাওয়া যায়। রুবেল তার স্ত্রী সোহেলী ইমরোজ পুনম ও রাফিয়া কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের নামে অর্জিত এই সম্পদ তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

রুবেলের শুরু

দুদকের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, রুবেল ১৯৯৮ সালে স্নাতক পাস করেছেন। এর আগে ১৯৯৬ সালে দিনাজপুরে 'সিংগার বাংলাদেশে' চাকরি গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে চাকরি ছেড়ে পুনরায় ফরিদপুর চলে আসেন। পরে ছোট একটি ফার্ম পরিচালনা করেন। তিনি ২০০১ সালে মেসার্স রাফিয়া কনস্ট্রাকশন প্রতিষ্ঠানের নামে ঠিকাদারি কাজ শুরু করেন। ২০১৭ সালে রাফিয়া কনস্ট্রাশনকে লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত করেন। স্ত্রী পুনম তার পরিচালক এবং ১০ শতাংশ শেয়ারের মালিক। নিজে ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) হিসেবে ৯০ শতাংশ শেয়ারের মালিক।

রুবেল ও তার কোম্পানির নামে ফরিদপুর শহর ও আশপাশে জমির ১০৬টি দলিল পাওয়া যায়। কোম্পানির নামে একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি, তার নিজ নামে পুরোনো টয়োটা গাড়ি ক্রয় করেন। কোম্পানির নামে চার-পাঁচটি মোটরসাইকেল আছে। কনস্ট্রাকশন কাজের জন্য তিন-চারটি ট্রাকসহ বিভিন্ন প্রকার ইকুইপমেন্ট রয়েছে। চণ্ডীপুর মৌজায় ভাড়া জমিতে ইটের ভাটা তৈরি করেছেন। স্ত্রীর ৫০ ভরি স্বর্ণ আছে।

আরও পড়ুন

×