ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বেসরকারি কলেজশিক্ষক

'অনুপাত প্রথা'র বঞ্চনা

'অনুপাত প্রথা'র বঞ্চনা

সাব্বির নেওয়াজ

প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৬:১৬

পাবনার চাটমোহর মহিলা ডিগ্রি কলেজের দর্শন বিষয়ের প্রভাষক ফাহিমা খন্দকার। মেধাবী ফাহিমা পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রী হিসেবে স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে দর্শন বিষয়ে ১৯৯৫ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচ) প্রথম শ্রেণিতে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি মাস্টার্স শেষ করেন। ২০০১ সালের ১৮ আগস্ট যোগ দেন চাটমোহর মহিলা ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক পদে।

চলতি বছরের ১৮ আগস্ট চাকরির ২০ বছর পূর্ণ করে তিনি পা রেখেছেন ২১তম বর্ষে। অথচ আজও তিনি 'প্রভাষক'ই রয়ে গেছেন। তার ছাত্রীরা বিসিএস দিয়ে অনেকে সরকারি কলেজের চাকরি নিয়ে সহযোগী অধ্যাপক পর্যন্ত হয়েছেন। অথচ তিনি সহকারী অধ্যাপকও হতে পারেননি।

ফাহিমা খন্দকারের সহকারী অধ্যাপক হতে না পারার মূল কারণ, সরকারের জারি করা 'বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা'। এ নীতিমালার কারণে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে একটি অনুপাত প্রথার উদ্ভব ঘটেছে, যা শিক্ষকদের মধ্যে ৫:২ হিসেবে পরিচিত। এর অর্থ, কোনো কলেজে এমপিওভুক্ত সাতজন প্রভাষক থাকলে তাদের মধ্যে মাত্র দু'জন সহকারী অধ্যাপক হতে পারবেন। বাকিরা আজীবন প্রভাষক হিসেবে থাকবেন, অর্থাৎ কোনো কলেজে মোট প্রভাষকের সংখ্যা ১৪ জন হলে, তাদের মাত্র চারজন সহকারী অধ্যাপক হবেন।

১৯৮০ সাল থেকে, অর্থাৎ ৪০ বছর ধরে এই অনুপাত প্রথাই অনুসরণ করা হচ্ছে বেসরকারি কলেজশিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে। চরম বৈষম্যমূলক এই নীতিমালার কারণে দেশের শত শত কলেজশিক্ষককে সারাজীবন প্রভাষক পদে থেকেই অবসর নিতে হচ্ছে। গত দুই দশকে এমপিওভুক্তির নীতিমালা ও জনবল কাঠামোয় কয়েক দফা সংশোধন করা হলেও এই অনুপাত প্রথার কোনো বিলোপ ঘটেনি। বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের 'গলার কাঁটা'য় পরিণত হয়েছে এই প্রথা।

বঞ্চনার এখানেই শেষ নয়, এমপিভুক্তির নীতিমালা ও জনবল কাঠামো অনুসারে বেসরকারি কলেজে সর্বোচ্চ পদ 'সহকারী অধ্যাপক'। এসব কলেজের ক্ষেত্রে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদের অস্তিত্বই রাখা হয়নি। অবশ্য রাজধানী ঢাকার তেজগাঁও কলেজ ও লালমাটিয়া মহিলা কলেজসহ কয়েকটি বড় কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের জ্যেষ্ঠ কোনো কোনো সহকারী অধ্যাপককে 'সহযোগী অধ্যাপক' বা 'অধ্যাপক' পদমর্যাদা দিলেও বেতন দেয়নি। তবে সরকারি নথিপত্রে তারা সবাই সহকারী অধ্যাপকই।

আসতে পারে 'সিনিয়র প্রভাষক' পদ: এদিকে, বর্তমানে এমপিওভুক্তির নীতিমালা সংশোধনের কাজ করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। কিন্তু উচ্চ শিক্ষা বিভাগ কলেজশিক্ষকদের অনুপাত প্রথা বাতিলের এই দাবি বিবেচনায় না নিয়ে প্রভাষক-সহকারী অধ্যাপকের অনুপাত বাড়িয়ে ১:১ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এ ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে সহকারী অধ্যাপকের বদলে 'সিনিয়র প্রভাষক' পদ রাখার কথা ভাবা হচ্ছে। এমপিও নীতিমালা সংশোধন কমিটির আহ্বায়ক মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক) মোমিনুর রশীদ আমিন সমকালকে বলেন, সরকার মোট প্রভাষকের অন্তত ৫০ শতাংশকে সহকারী অধ্যাপক করার চিন্তা করছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বেসরকারি কলেজ-মাদ্রাসায় সহযোগী অধ্যাপক বা অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা হবে কিনা, তা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। এ বিষয়ে বলার জন্য উপযুক্ত লোক আমি নই।

মানসিক চাপে প্রভাষকরা: বছরের পর বছর একই পদে চাকরি করে যাওয়ার গ্লানি মনে ও কাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে জানিয়ে প্রভাষক ফাহিমা খন্দকার বলেন, এই বেদনার কথা কাউকে বলে বোঝানো কঠিন। খুব বেশি খারাপ লাগে। একই সঙ্গে যোগ দিলাম, কেউ পদোন্নতি পেলেন, কেউ পেলেন না। সমান যোগ্যতা নিয়ে কম বেতনে নিম্ন পদে বছরের পর বছর যাদের কাজ করতে হয়, সেই ভুক্তভোগীরাই কেবল এ যন্ত্রণা বুঝতে পারবেন।

ফাহিমার মতোই চাটমোহর মহিলা ডিগ্রি কলেজে অন্তত ২০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে প্রভাষক পদে চাকরি করছেন অর্থনীতির আলফাজ উদ্দিন, ইতিহাসের মোতাহেরা বানু, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রফিকুল ইসলাম ও অর্থনীতির মাহবুবুল ইসলাম। একই কলেজে ১৯৯৬ সালে যোগ দিয়ে ২৪ বছর ধরে প্রভাষক পদে চাকরি করছেন সমাজবিজ্ঞানের ফারহানা বেগম। ১৯৯৭ সালে যোগ দিয়ে ২৩ বছর ধরে জীববিজ্ঞানে প্রভাষক পদেই আছেন জেসমিন আক্তার।

ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া অনার্স কলেজে টানা ৩০ বছর 'প্রভাষক' পদে চাকরি করে সম্প্রতি অবসরে যান মনোবিজ্ঞানের তাহেরা বেগম। একই কলেজের ইসলাম শিক্ষা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হাফেজ মুহাম্মদ রুহুল আমিন প্রভাষক পদে আছেন টানা ২৪ বছর; ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের প্রভাষক অরুপ কুমার বসাক ও বাংলা বিভাগের সাইফুন নাহার পারুল আছেন ২০ বছরের বেশি সময় ধরে।

ময়মনসিংহ সদরের কাতলাসেন কাদেরিয়া কামিল মাদ্রাসার জীববিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক বিলকিছ জাহান নয়ন সমকালকে বলেন, সহকারী অধ্যাপক হওয়ার নির্ধারিত শর্ত হলো, আট বছরের প্রভাষক পদে চাকরি থাকতে হবে। অথচ অনুপাত প্রথার কারণে তিনি ১২ বছর প্রভাষক পদে থেকেও পদোন্নতি পাননি। কারণ, তার মাদ্রাসায় প্রভাষকের সংখ্যা কম ছিল। তিনি বলেন, বেসরকারি কলেজ ও মাদ্রাসা থেকে অনুপাত প্রথা উঠিয়ে দেওয়া হোক- এটা হাজারো শিক্ষকের প্রাণের দাবি।

টানা ২৭ বছর ধরে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার পিপলস ডিগ্রি কলেজের মনোবিজ্ঞানের প্রভাষক গুল শাহানাজ রশীদ। তিনি ১৯৯৩ সালে এ কলেজে চাকরি পেয়েছিলেন। একই কলেজে ১৯৯৮ সালে চাকরি পেয়ে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে যাচ্ছেন ইংরেজি বিভাগের ফজলুল হক। দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এই শিক্ষক বলেন, ২২ বছর ধরে একই পদে আছি। আর মাত্র পাঁচ বছর চাকরি আছে। এই পদ থেকেই বিদায় নিতে হবে।

দুই যুগেরও বেশি কেবল প্রভাষক পদেই চাকরি করছেন- এমন উদাহরণও সারাদেশে শত শত। সবাই বৈষম্যমূলক এই অনুপাত প্রথার নির্মম শিকার হয়েছেন। সারাদেশের বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রাণের দাবি- অনুপাত প্রথার বিলোপ।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (বেসরকারি কলেজ) এনামুল হক হাওলাদার বলেন, বর্তমানে পদোন্নতির ক্ষেত্রে 'বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিওভুক্তির নীতিমালা-২০১৮' অনুসরণ করা হয়। এতে বলা আছে, প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপকের অনুপাত হবে ৫:২। কোনো বেসরকারি কলেজে সাতজন শিক্ষক থাকলে তাদের মধ্যে দু'জন সহকারী অধ্যাপক হবেন। উচ্চ মাধ্যমিক কলেজগুলোতে প্রতি বিষয়ে একজন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হন। ডিগ্রি স্তর থাকলে আরেকজন এমপিওভুক্ত হতে পারেন। অনার্স-মাস্টার্সের জন্য কেউ এমপিওভুক্ত হন না। তিনি জানান, এ নীতিমালা অনুসারে বেসরকারি কলেজে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ নেই। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেগুলেশনসে তা আছে।

মাউশি থেকে জানা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে এমপিওভুক্ত ডিগ্রি কলেজ আছে এক হাজার ৩৬টি। স্কুল অ্যান্ড কলেজে আছে এক হাজার ৪৯১টি এবং উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ আছে এক হাজার ২৮টি। নন-এমপিওভুক্ত কলেজও আছে প্রায় দুই হাজারের মতো। এসব কলেজে প্রায় দেড় লাখ কলেজশিক্ষক রয়েছেন। মাদ্রাসায় কর্মরত প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপকদের হিসাব সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। পদোন্নতি পেতে প্রভাষকদের চাকরিকাল কমপক্ষে আট বছর হতে হয়। যারা সহকারী অধ্যাপক হতে পারেন না, তারা চাকরির ১০ বছর পূর্তিতে উচ্চতর স্কেল পান। এতে তারা জাতীয় বেতন স্কেলের নবম থেকে অষ্টম গ্রেডে উন্নীত হন। পদোন্নতি-বঞ্চিতদের চাকরির ১৬ বছর পূর্তিতে আরেকটি গ্রেড স্কেলে উন্নীত হওয়ার বিধান রয়েছে। যদিও কয়েক বছর ধরে আদালতে মামলার কারণে তা স্থগিত রয়েছে। শিক্ষকরা জানান, ২০১০ সালে সংশোধিত এমপিওভুক্তির নীতিমালায় বেসরকারি কলেজের জন্য সহযোগী অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। তবে তা কার্যকর করা হয়নি। ২০১৮ সালের সংশোধনীতে তা নীতিমালা থেকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়।

শিক্ষক নেতারা যা বলেন: বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির (বাকশিস) সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হক বলেন, অনুপাত প্রথার মতো চরম বৈষম্যমূলক ও নিপীড়নমূলক প্রথা আর হয় না। এগুলোর অবসান হওয়া উচিত। জাতীয় শিক্ষকনীতিতে বেসরকারি কলেজে অধ্যাপক পর্যন্ত পদ সৃষ্টির কথা আছে। অথচ তা কার্যকর করা হচ্ছে না। বহুবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও অনুপাত প্রথা তুলে দেওয়া হয়নি। বর্তমানে জনবল কাঠামোর সংশোধনীর কাজ চলছে- সেখানে সত্যিকারের শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্বকারী কেউ নেই। আমরা বাকশিস থেকে ১১টি দাবি লিখিতভাবে এ কমিটিকে দিয়েছি। সেখানে পরিস্কারভাবে এই অনুপাত প্রথা তুলে দিতে বলেছি।

বাকশিসের সাধারণ সম্পাদক ও রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া অধ্যক্ষ মো. ফয়েজ আহমেদ বলেন, যে চাকরিতে কোনো পদোন্নতি নেই, তাকে চাকরি বলা যায় না। সেখানে কর্মস্পৃহাও থাকে না। শত শত শিক্ষক বছরের পর বছর প্রভাষক পদে চাকরি করছেন, দেখার কেউ নেই। তিনি বলেন, শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ হলে এ আঁধার কেটে যাবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন এ বিষয়ে বলেন, বেসরকারি কলেজশিক্ষকদের পদোন্নতিতে অনুপাত প্রথার বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। এ ব্যাপারে সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ ও চিন্তাভাবনা রয়েছে। এমপিওভুক্তির নীতিমালায় শিক্ষকদের স্বার্থেই প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

×