মনপুরায় বসেই বিতর্কিত ইস্যু ভাইরাল করে 'ওএমজি'

গ্রেপ্তার আলামিন
সাহাদাত হোসেন পরশ
প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৫:৫৩
'নবাব এলএলবি' সিনেমায় পুলিশের ভূমিকায় অভিনয় করা একজন কর্মকর্তা ধর্ষণের শিকার এক নারীকে কুরুচিপূর্ণ ও অশ্নীল সব প্রশ্ন করছিলেন। অনলাইন অ্যাপে সিনেমার একটি খণ্ডিত অংশ মুক্তি পাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কিছু সাইট থেকে মুভিটির অশ্নীল অংশ ভাইরাল হয়।
গত ১৬ ডিসেম্বর 'আই থিয়েটার' অ্যাপে মুক্তি পায় 'নবাব এলএলবি' ছবিটি। ওইদিন সিনেমার অর্ধেক অংশ মুক্তি দেওয়া হয়। বাকি অর্ধেক মুক্তি দেওয়া হবে আগামী ১ জানুয়ারি। চলচ্চিত্রটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাকিব খান, মাহিয়া মাহি, অর্চিতা স্পর্শিয়া ও শহীদুজ্জামান সেলিম। প্রযোজনা করেছে সেলিব্রেটি প্রোডাকশন।
সিনেমার দৃশ্যে পুলিশকে হেয় করার ঘটনায় পর্নোগ্রাফি আইনে দায়ের করা মামলায় এরই মধ্যে পরিচালক অনন্য মামুন ও অভিনেতা শাহীন মৃধাকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। তবে চলচ্চিত্র সংশ্নিষ্টরা বলছেন, অনলাইন অ্যাপে সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ মুক্তি দেওয়ার আগে একটি সেন্সর বোর্ড থাকা দরকার। যারা কোনো অশ্নীল বা বিতর্কিত বিষয় থাকলে সেটি বাদ দিতে তাদের মতামত তুলে ধরবে। আটক বা গ্রেপ্তার করা সমাধান নয়। আগামীতে কীভাবে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো যায় সেটি নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। কেউ কেউ অবশ্য এমন মতও দিচ্ছেন যে, বাংলাদেশে নাটক, সিনেমা কিংবা সাহিত্যে চরিত্র নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিধি ছোট হয়ে আসছে।
এদিকে 'নবাব এলএলবি'র নামে চলচ্চিত্রের অশ্নীল অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে 'ওএমজি' নামে একটি পেজের খোঁজ মিলেছে। ওই পেজ থেকে আরও কিছু ইস্যুতে বিতর্ক তৈরি করে ভাইরাল করা হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী সেন্সর বোর্ড থেকে চলচ্চিত্র মুক্তির আগে ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে 'নবাব এলএলবি'র এ সিনেমাটির অ্যাপে মুক্তি দেওয়ার কারণে সেই বিধান মানতে হয়নি।
জানা গেছে, নবাব এলএলবি চলচ্চিত্রের অংশ পেজে দিয়ে ওএমজির অ্যাডমিন ক্যাপশনে লিখেছিল- 'দেখুন মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়ে পুলিশের কাছে এসে কী কী বলে।' পুলিশের একাধিক সংস্থা পেজের অ্যাডমিনের ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করে। এরপর বেরিয়ে আসে- দ্বীপ জেলা ভোলার মনপুরায় বসেই 'ওএমজি' নামে ওই পেজটি চালিয়ে আসছিলেন মো. আলামিন নামে এক মাদ্রাসা ছাত্র। এলাকায় তার একটি মোবাইল ফোনের দোকান রয়েছে। মনপুরার ১ নং কলাতুলীর চরে তার বাড়ি। তার বাবার নাম মো. হাছান। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে শুক্রবার আলামিনকে গ্রেপ্তার করে মনপুরা থানা পুলিশ। তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। ওই মামলায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। শুনানির দিন আজ রোববার।
পুলিশ জানায়, ওএমজি আইডি থেকে এর আগেও পদ্মা সেতু নিয়ে কুৎসা রটান আলামিন। তার পেজে বিভিন্ন ছবি দিয়ে সেতুর ব্যাপারে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন। এ ছাড়া মাছের বিভিন্ন ছবি এবং অশ্নীল তথ্য ওএমজিতে পোস্ট করেন।
ভোলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার সমকালকে বলেন, নিজের পেজের 'লাইক ও শেয়ার' বাড়াতে বিতর্কিত সব ইস্যু টার্গেট করতেন আলামিন। মূলত তার পরিকল্পনা ছিল এই প্ল্যাটফর্ম জনপ্রিয় করে বাড়তি কিছু আয় করা। মিথ্য সব তথ্য দিয়ে 'ওএমজি' নামে ওই আইডি খুলেছিলেন আলামিন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের পরিদর্শক নাসিরুল আমিন বাদী হয়ে রমনা থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, 'সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে ধর্ষণের শিকার এক নারী থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করছেন। প্রচারিত ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রশ্নোত্তর চলছে। সেখানে ধর্ষণের বর্ণনা ও জিজ্ঞাসাবাদ অত্যন্ত অশ্নীল ও আপত্তিকর ভাষায় করা হয়েছে। যা শ্রবণযোগ্য নয়। সুস্থ বিনোদনের পরিপন্থি হওয়ায় পরিবার-পরিজনসহ একত্রে বসে এ ছায়াছবি দেখা সম্ভব নয়। একইসঙ্গে জনসাধারণের মধ্যে পুলিশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করবে। এই ভিডিওটি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর জন্য অত্যন্ত মানহানিকর এবং ভিডিওর মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে জনসাধারণের সামনে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে।'
২০১৫ সালের এপ্রিলে চলচ্চিত্র পরিচালক, পরিবেশক ও প্রযোজকদের চিঠি দিয়ে পুলিশের চরিত্রে অভিনয় ও পোশাক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ মেনে চলতে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুসফিকুর রহমান গুলজার সমকালকে বলেন, অনলাইন অ্যাপে সিনেমা, ওয়েব সিরিজ ও অন্য কোনো কনটেন্ট ছাড়ার আগে তা দেখভালের একটি কর্তৃপক্ষ থাকা দরকার। আমরাও অনেক দিন ধরে সেটি চাচ্ছি। কারণ অপরিপকস্ফ লোকজনকে স্বাধীনতা দেওয়া হলে তার অপব্যবহার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অ্যাপে সিনেমা এবং ওয়েব সিরিজ মুক্তির আগে একটি সেন্সর বোর্ডের মাধ্যমে তা যাচাই করা হবে- এটি বাস্তবায়নে কাজ করছে মন্ত্রণালয়। আশা করি দ্রুত এই বোর্ড তৈরি হবে।
চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সভাপতি মোরশেদ আলম সমকালকে বলেন, স্বাধীনভাবে আমরা কাজ করতে চাই। তবে স্বাধীনভাবে কাজ করার অর্থ এটা নয় যে, পরিবার, সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, এমন কিছু করব। এর আগে ওয়েব সিরিজ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। অনেক আগেই অনলাইন অ্যাপে সিনেমা বা নাটক মুক্তির ব্যাপারে সেন্সর বোর্ড থাকার দরকার ছিল। সেন্সর না থাকায় এর সুযোগ নিচ্ছে কেউ কেউ।
চলচ্চিত্রটির অভিনেত্রী স্পর্শিয়া শনিবার বলেন, 'আমার তো কোনো অন্যায় দেখছি না। মামলা হয়েছে। পুলিশ ডাকলে আমি তাদের জবাব দিতে যাব।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) ওয়ালিদ হোসেন সমকালকে বলেন, 'নবাব এলএলবি' চলচ্চিত্রে পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে অভিনেতা ধর্ষণের শিকার নারীকে যেসব প্রশ্ন করেছেন, তা শুধু বাহিনীর ভাবমূর্তির বিষয়ে সঙ্গে সংশ্নিষ্ট নয়। এই ধরনের কুরুচিপূর্ণ ও অশ্নীল সংলাপ আমাদের সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মামলায় অভিনেতা ও পরিচালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্তে পরে অন্য কারও নাম এলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
অভিনেতার দায় কি শুধু অভিনয় করা- এমন প্রশ্নে ওয়ালিদ হোসেন বলেন, কী ধরনের চরিত্রে অভিনয় করা হচ্ছে এটা যাচাইয়ের জন্য অভিনেতার ভূমিকা রয়েছে। তার একটা মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড থাকতে হবে। আর পুলিশ একটি শৃঙ্খলা বাহিনী। কোনো নাটক-সিনেমায় পুলিশের পোশাক ব্যবহার করতে হলে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার বিধান রয়েছে। নবাব এলএলবি সিনেমার সঙ্গে সংশ্নিষ্টরা এই অনুমতি নেয়নি।
- বিষয় :
- ওয়েব সিরিজ
- মনপুরা
- বিতর্কিত ইস্যু
- ওএমজি
- অনলাইন অ্যাপ