ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

প্রেরণার কথা: সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী

শিখরের পথে যাত্রা

শিখরের পথে যাত্রা

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ড. মেলিটা মেহজাবিন, সহযোগী অধ্যাপক, আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৫:৫০

বেড়ে ওঠা

পাঁচ বছর বয়সে আমার বাবা মারা যায় এবং এরপর বড় ভাইয়েরাই আমাকে বড় করেছেন। বড় ভাই আইনজীবী ছিলেন, পরে প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরিবারের সবাই খুব স্বাধীনচেতা। মোটকথা, তারা সবাই সহজ-সাধারণ জীবনধারায় বিশ্বাসী; তাদের জীবনের মূল প্রেরণা জ্ঞান ও দর্শনচর্চায়। দিন শেষে সবকিছু মিলিয়ে এই সাধারণ জীবনধারার মূল দর্শনের বিপরীতে গিয়ে আমার মাঝে নতুন কিছু করার এক ধরনের তাগিদ তৈরি হয়। আমার মনে হতে থাকে, শুধু সাধারণ জীবন ধারণ নৈতিকতার পরিচয় বহন করতে পারে- এটি একটি ভুল ধারণা এবং বলা যেতে পারে, এখান থেকেই এ ধারণাকে ভুল প্রমাণের জন্য কিছুটা বিদ্রোহী হয়ে উঠি।

শুরুটা যাকে অনুসরণ করে

বোর্ডিং স্কুলে আমার বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলেমেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানে পরিচয় হয় আমার এক বন্ধুর সঙ্গে। সে রাঁচির একটা বড় ব্যবসায়ী পরিবার থেকে এসেছিল। তার সঙ্গে ভারতের টাটানগর ঘুরতে গেলাম; সেখানে বন্ধুর বাবা চাকরি করত। টাটা ইন্ডাস্ট্রি দেখেই জামশেদজি টাটা আমার রোল মডেলের জায়গাটি দখল করে ফেলেন। এর মাঝে এক-দু'বার আমার ভাইদের বলেছিলাম, ব্যবসা করতে চাই। এতে তারা টিটকারি করছিল আর হেসে বলেছিল, তুই ব্যবসার কী বুঝিস? ব্যবসা করবি? আমাদের চৌদ্দপুরুষের কেউ ব্যবসা করেনি। এসব বাজে কথা ফেলে তুই আইনে পড়াশোনা কর অথবা সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বস্‌। হতে পারে ভাগ্যগুণে এর পর পাকিস্তান টোব্যাকো থেকে চাকরির অফার পেয়ে যাই এবং শুরুতেই বেতন এতটা ভালো ছিল ও এত সুযোগ-সুবিধা ছিল যে, আমার মূল অভিভাবক হিসেবে বড় ভাই বললেন, সিভিল সার্ভিস বাদ দিয়ে তুই করপোরেটে চাকরি করতে পারিস। ওখানে নৈতিক মূল্যবোধের ব্যবহার আছে, করপোরেট সোশ্যাল দায়িত্ব পালনের তাগিদ আছে। সব মিলিয়ে খারাপ না।

স্বাধীনতার পর সুযোগের হাতছানি

যখন দেশ স্বাধীন হলো, দেখলাম দেশের বাণিজ্য আর শিল্প খাত নিয়ন্ত্রণে নেতৃত্বের বিশাল এক শূন্যতা। এ জন্য একটা সুযোগ খুঁজছিলাম, কীভাবে পাকিস্তান টোব্যাকো ছাড়া যায় এবং নিজের ব্যবসা শুরু করা যায়। কিন্তু কোনো একটা কারণে সেভাবে উদ্যোগের সুযোগ হয়ে উঠছিল না। একদিন একটা ডিনার পার্টিতে এক ফরাসির সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে কথা বললেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী করি। আমার চাকরির কথা তাকে জানালাম। জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কী করেন। জানালেন, আমদানি-রপ্তানি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তিনি বললেন, চামড়া আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করি। তুমি কি জয়েন করবে? আমি তাকে না করে জানালাম, যেহেতু ভালো সংস্থার সঙ্গে কাজ করছি, সে জন্য এই মুহূর্তে অন্য চাকরির দরকার নেই। তিনি আমার ভুল ভাঙিয়ে বললেন, 'না না। আমি তোমাকে চাকরি অফার করছি না। তুমি আমার লেদারের পণ্য যা বিক্রি করবে, তার থেকে একটা কমিশন পাবে। আর তুমি এখান থেকে যেসব চামড়া ক্রয় করবে, তার ওপর একটা কমিশন পাবে। তুমি কি আগ্রহী?' পরে হিসাব করে দেখলাম, বেশ বড় একটা পরিমাণ টাকা মাস শেষে তাহলে হাতে চলে আসছে। তবুও যেহেতু নতুন কিছু একটা করার যুক্তিতে এটা বেশ বড় একটা সিদ্ধান্ত, তাই চিন্তা করতে একটু সময় চেয়ে নিলাম। যখন স্ত্রীর সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করলাম, সে বলল, মাথা খারাপ! তুমি ব্যবসার কী বোঝো? আমার বড় ভাই হুমকি দিলেন, তুই যদি যাস এটাতে, তোর সঙ্গে জীবনে কথা বলব না আর। তখন যে মানুষটা আমাকে অনেক সাহায্য করলেন, তিনি আমার শ্বশুর। বললেন, না বাবা, তোমাকে এ ব্যাপারে সমর্থন করি। সে সময় এটাই অনেক সাহস জুটাল।

চ্যালেঞ্জ নিয়ে ব্যবসার শুরু

এই যে যাত্রা শুরু হলো, ৬-৭ মাস ধরে ওঠানামা চলল। চিটাগং পোর্ট খুলে গেল; রাশিয়ানরা করছিল স্যালভেজিং। ওইটা খুলে গেল, তখন একটু উন্নতি হলো। আমরা পোর্ট ব্যবহার করলাম আর খুব ভালো করলাম। তারপর '৭৫-এ বড় দুর্ঘটনাটা ঘটল। সরকার পরিবর্তন হলো এবং ওই সরকার তখন চামড়া খাতকে বেসরকারি করে ফেলল। ওরিয়েন্ট ট্যানারিকে তখন নিলামে তোলা হলো। নিলামে গিয়ে ১২ লাখ ২২ হাজার টাকায় সেটা কিনলাম। যেটা ১৯৭৫ সালে অনেক টাকা ছিল। এভাবেই চামড়া শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। বাকিটা ইতিহাস।

একজন তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে প্রথমে আমার চাকরি থেকে ইস্তফা দিলাম। এর পর পুঁজি আর জমানো টাকা যা ছিল, সেটা দিয়ে ট্যানারিটা কিনলাম। কিন্তু ব্যবসায় খাটানোর জন্য মূলধন তো লাগবেই। এখন মূলধন কোথায় পাই? তখন একটা দুটো ছাড়া সব ব্যাংক সরকারি। কয়েকটা জায়গায় আমার আবার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুরা ভালো পজিশনে ছিল। তাদের কাছে সাহায্যের জন্য গেলাম। তবে সিকিউরিটির জন্য কোনো কিছু না থাকায় তারা আমাকে মানা করে দিল।

উদ্যোক্তাদের জন্য আমার মেসেজ হচ্ছে, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সবচেয়ে বড় সমস্যা। এখন অনেক ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট আছে, তারা গ্রিন ফিল্ড প্রজেক্টে টাকা দেয়। উদ্যোক্তাদের একটা ফান্ড সরকার তৈরি করেছে, সেখানে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেবে। তো, এইগুলো আছে। এটার ওয়েবসাইটও আছে। তরুণ উদ্যোক্তাদের বলব, তারা যেন একটু দেখে। কিন্তু আগের থেকে অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে; কোনো সন্দেহ নেই।

দেশকে নিয়ে স্বপ্ন

আমার মনে হয়, আমাদের এখানে একটা দুর্ভাগ্য, একটার পর একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। '৭৫ সালে বিরাট দুর্ঘটনা ঘটল। তারপর তো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সেভাবে ছিল না। ১৯৯০ থেকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল। গণতন্ত্র আর উন্নয়ন হাতে হাত ধরে চলে। গণতন্ত্র আর আইনের শাসন থাকলে বিনিয়োগ আসবেই। আমার দরকার আরও বিনিয়োগ। বিনিয়োগ মানেই কর্মসংস্থান আমাদের জন্য। শুধু বাংলাদেশের জন্য না, বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কর্মসংস্থান তৈরি সবচেয়ে বড় সমস্যা।

একজন উদ্যোক্তার জন্য বন্ধু আসলে কে?

আমার মতে, উদ্যোক্তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ব্যাংকার। কোনো অবস্থাতেই ব্যাংকারকে অখুশি করা যাবে না। সে জন্য উদ্যোক্তা যারা আছেন, মনে রাখবেন, ব্যাংকাররা আপনার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। আর যেভাবেই হোক, ব্যাংকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। আর আপনার পেছনে যদি একটা ব্যাংকার থাকে, জীবন অনেক সহজ হয়ে যায়। আমার তরুণ বন্ধুরা, সব সময় এটা মনে রাখতে হবে। ব্যাংকারকে সব সময় খুশি রাখতে হবে।

নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু কথা

শোনার অভ্যাস করতে হবে। যদি সব সময় নিজেরটা বলেন, কারও কথা না শোনেন, তাহলে প্রতিষ্ঠান চালাতে পারবেন না। সবাই তাদের কথা বলুক। আর আপনার উদাহরণ দিয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। ৩০-৪০ বছর আগে এত পরিণত ছিলাম না। অনেক অধৈর্য ছিলাম। কম ধৈর্য নিয়ে সমস্যা সমাধান হয় না। মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করতে হবে। আমার নিজের কোম্পানিতে বলি, সবসময় মনের কথা বলতে হবে। সব সময় বলি- ভালোবাসার চেয়ে শ্রদ্ধা অনেক শক্তিশালী।

সাক্ষাৎকারের ভিডিও দেখতে প্রেরণা ফাউন্ডেশনের অফিসিয়াল ইউটিউব  চ্যানেল ভিজিট করুন

আরও পড়ুন

×