ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

সুখবর

কফিতে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন

কফিতে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন

খাগড়াছড়িতে কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বাগান থেকে পাকা কফি তুলছেন এক নারী - সমকাল

জাহিদুর রহমান, খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১৫:২০

খাগড়াছড়ির উঁচু পাহাড়ের কোলে শত শত বৃক্ষ। অসংখ্য সবুজ পাতার ভিড়ে কিছু গাছের তেলতেলে পাতাও দোল খাচ্ছে বাতাসে। গুচ্ছ গুচ্ছ লাল-সবুজ রঙের ছোট আকারের ফল ধরেছে সেই গাছে। জানা না থাকলে যে কারোরই মনে হতে পারে, এটি কোনো বুনো ফল। লাল হওয়া পাকা সেই ফল ছিঁড়ে ঝুড়িতে রাখছেন বিরোবালা ত্রিপুরা (৪০)। জানালেন, এগুলো কফি। গাছ থেকে তোলার পর হাতলচালিত বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে এসব ফলের ওপরের আবরণ তুলে ফেলা হয়। তারপর রোদে শুকিয়ে গ্রাইন্ডার মেশিনের সাহায্যে গুঁড়া করে বাজারজাত করা হয়।

খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে দুই একরের মতো জমিতে ৩৭০টি গাছে এই কফি এসেছে। এ গবেষণা কেন্দ্রের সহায়তায় জেলায় ব্যক্তি উদ্যোগেও বাড়ছে কফির আবাদ। বান্দরবান, রাঙামাটিসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কফি চাষেই সুদিনের স্বপ্ন দেখছেন চাষিরা। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের চাহিদা মিটিয়ে কফি রপ্তানির সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্নিষ্টরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) হর্টিকালচার উইংয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের তিনটি জেলার মধ্যে বান্দরবানেই ৯০ শতাংশ কফি উৎপাদিত হচ্ছে। নীলফামারী, রংপুর এবং টাঙ্গাইলেও কফির চাষ শুরু হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কফির উৎপাদন এলাকা ছিল প্রায় ১১৮.৩ হেক্টর, মোট উৎপাদন হয়েছে ৫৫.৭৫ টনের মতো।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে ২০১৯ সালে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নে এক হাজার চারার তিনটি কফির বাগান করা হয়। একইভাবে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় করা হয় কফির সাতটি নতুন বাগান। এসব বাগানে এ বছরই শুরু হয়েছে ফল উৎপাদন।

খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুন্সী রাশীদ আহ্‌মদ সমকালকে বলেন, কফি চাষে পাহাড় কিংবা অন্য ফসলের কোনো ক্ষতি হয় না। কফি মরু অঞ্চলের উদ্ভিদ হওয়ায় সহজেই মিশ্র ফসল হিসেবে বনজ উদ্ভিদের সঙ্গে হালকা ছায়ায় সেচবিহীন অবস্থায় চাষ করা যায়। এতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হয় না বললেই চলে।

পার্বত্য অঞ্চলে কফি চাষ করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৯২ শতাংশ উঁচু, দুই শতাংশ মধ্য উঁচু এবং এক শতাংশ নিচু ভূমি আছে। নিচু ভূমি ছাড়া পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড় কফি চাষের উপযোগী। খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র বছর বিশেক আগে প্রথম কফি নিয়ে গবেষণা শুরু করে।

তিনি জানান, বর্তমানে পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে ৩৯৫টি রোবাস্টা এবং ২০০টি অ্যারাবিকা কফির চারার বাগান রয়েছে। এক হেক্টর জমির জন্য পাঁচ হাজার বীজ প্রয়োজন হয়। গত বছরও এই গবেষণা কেন্দ্র থেকে ২০ হাজার কফি চারা উৎপাদন করা হয়, যা ২০ টাকা পিস হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। চাষের ক্ষেত্রে প্রতিটি গাছের জন্য খরচ হয় মাত্র একশ থেকে দেড়শ টাকা। প্রতিটি গাছ থেকে বছরে আধা কেজির বেশি কফির শুকনো ফল পাওয়া যায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাঙামাটি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক পবন কুমার চাকমা জানান, বর্তমানে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান তিন পার্বত্য জেলায় ১০২ হেক্টর জমিতে কফি আবাদ হচ্ছে। যার মধ্যে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২১ টন কফি।

এ গবেষণার সাফল্য হিসেবে বারি কফি-১ রিলিজ দেওয়া হবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. নাজিরুল ইসলাম বলেন, এ দেশে কফি চাষ কৃষকের মধ্যে জনপ্রিয় না হওয়ার অন্যতম কারণ কফি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাত করার সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান করতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি প্রকৌশল বিভাগ এবং পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে একটি কফি গ্রাইন্ডার উদ্ভাবন করা হয়েছে। যার বাজারমূল্য তিন হাজার টাকা। এই গ্রাইন্ডারের মাধ্যমে কৃষকরা সহজেই কফি গুঁড়া করে বাজারজাত করতে পারবেন। বারি উদ্ভাবিত পাল্পারের সাহায্যে ঘণ্টায় ২৫ থেকে ৩০ কেজি কফির খোসা ছাড়ানো সম্ভব হয়, যা অত্যন্ত সাশ্রয়ী এবং কার্যকর।

খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুন্সী রাশীদ আহমদ জানান, আশা করা যাচ্ছে সামনের দিনগুলোতে এখানে কফি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে উঠবে এবং কফি পাহাড়ের অন্যতম অর্থনৈতিক ফসলে পরিণত হবে।

কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কফিকে লাভজনক ও জনপ্রিয় ফসল করতে কৃষক পর্যায়ে সব রকম সহায়তা দেওয়া হবে। আশা করছি, আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ কফির আবাদ হবে। আবাদ বাড়াতে পারলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে কফি বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে।

আরও পড়ুন

×