ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

নেই ড্রেস কোড, তবুও টাকা নেন কর্মকর্তারা

নেই ড্রেস কোড, তবুও টাকা নেন কর্মকর্তারা

তৌফিকুল ইসলাম বাবর, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ২৮ জুন ২০২১ | ১৪:২৮

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কর্মকর্তাদের কোনো 'ড্রেস কোড' কিংবা 'ইউনিফর্ম' নেই। তবুও প্রতি বছর স্যুট-কোটসহ দুই দফায় পোশাক নেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা! আগে থেকেই বছরে দুই দফায় পোশাক পেতেন সংস্থার কর্মচারীরা। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের 'মনঃকষ্ট' ছিল। সেই মনঃকষ্ট দূর করতে কর্মচারীদের পাশাপাশি কর্মকর্তাদেরও বছরে দু'বার পোশাক দেওয়া হচ্ছে। আবার এই পোশাক নিয়ে চলছে এক ধরনের জালিয়াতি। বিপিসির বিধি অনুযায়ী কাপড় কিনে, সেই কাপড় সেলাই করে সংস্থার স্টোরে জমা দিতে হবে এবং তারপরই বিল নেওয়ার কথা। আবার এর প্রমাণ হিসেবে সংশ্নিষ্ট কাপড়ের দোকান ও টেইলার্সের রসিদ জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু অস্তিত্বহীন দোকান ও টেইলার্সের নামে ভুয়া রসিদ বানিয়ে সংস্থা থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন প্রায় সব কর্মকর্তা!
বিপিসি কর্মকর্তাদের পোশাক সংক্রান্ত কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, প্রায় সব কর্মকর্তাই পোশাক নিচ্ছেন। গ্রীষ্ফ্মকালীন পোশাক হিসেবে পুরুষ কর্মকর্তাদের জন্য শার্টের কাপড় চার গজ। প্রতি গজ ৭০০ টাকা করে দুই হাজার ৮০০ টাকা। এক হাজার টাকা করে পৌনে তিন গজ প্যান্টের কাপড় দুই হাজার ৭৫০ টাকা। শার্ট ও প্যান্ট সেলাই প্রতিটি ৯০০ টাকা করে এক হাজার ৮০০ টাকা। নারী কর্মকর্তার বেলায় দুটি টাঙ্গাইল ব্র্যান্ডের শাড়ি তিন হাজার ৬৭৫ টাকা করে সাত হাজার ৩৫০ টাকা। শীতকালীন পোশাক হিসেবে পুরুষ কর্মকর্তাদের জন্য নেভি ব্লু স্যুটের কাপড় তিন গজ। প্রতি গজ দুই হাজার টাকা করে ছয় হাজার টাকা। কমপ্লিট স্যুট সেলাই মজুরি চার হাজার ৫০০ টাকা।
নারী কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে একটি করে সিল্ক্ক শাড়ি। দাম ছয় হাজার ৫০০ টাকা। উলের শাল চার হাজার টাকা। প্রত্যেক পুরুষ ও নারী কর্মকর্তার জুতা (বাটা ব্র্যান্ডের) বাবদ তিন হাজার ৫০০ টাকা। এ হিসাবে প্রত্যেক পুরুষ ও নারী কর্মকর্তার পেছনে প্রতি বছর পোশাক বাবদ গড় ব্যয় ২৪ হাজার ৮৫০ টাকা।
কাপড় কিনে সেলাই করে সংস্থার স্টোরে জমা দিয়ে বিল নেওয়ার বাধ্যবাধকতার কথা থাকলেও তা তো করাই হয় না, উল্টো জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে টাকা তুলে নেন প্রায় সব কর্মকর্তা। এমনকি টাকা তুলে নিতে নিজেরাই বিভিন্ন দোকানের ভুয়া রসিদ ও বিল-ভাউচার তৈরি করে জমা দিচ্ছেন।
চট্টগ্রাম নগরীর টেরিবাজার হানিমুন টেইলার্স অ্যান্ড ফেব্রিক্স থেকে পুরুষ কর্মকর্তাদের জন্য শীতকালীন নেভি ব্লু স্যুটের কাপড় এবং নারী কর্মকর্তাদের জন্য সিল্ক্ক ও উলের শাড়ি সংগ্রহ করা হয় উল্লেখ করে একটি বিল-ভাউচার করা হয়। এজন্য এক ভাউচারেই ৩৯ কর্মকর্তার জন্য পোশাক সংগ্রহ করে নগদে ওই টেইলার্সকে তিন লাখ ৬১টি হাজার ৭২৫ টাকা দেওয়া হয় বলে উল্লেখ করা রয়েছে। কিন্তু টেরিবাজারে গিয়ে সেই হানিমুন টেইলার্সের কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও সেখানে এই টেইলার্সের সন্ধান দিতে পারেননি। হানিমুন টেইলার্সে কেবল পুরুষদের প্যান্ট-শার্ট এবং স্যুট-কোটের কাপড় বিক্রি ও সেলাই করা হয়। নগরীর ষোলশহর শপিং কমপ্লেক্সে হানিমুনের বড় একটি শাখা রয়েছে। সেখানে গিয়েও এই চিত্র দেখা গেছে। কিন্তু টেরিবাজারের অস্তিত্বহীন হানিমুন টেইলার্স থেকে বিপিসির নারী কর্মকর্তাদের জন্য কেনা হয়েছে সিল্ক্কের শাড়ি ও উলের শালও! বাটা ব্র্যান্ডের জুতা ক্রয়ের ভুয়া রসিদ বানিয়ে একই রকম জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন কর্মকর্তারা।
ষোলশহর শপিং কমপ্লেক্সে থাকা হানিমুনের ম্যানেজার মনজুর ইসলাম সমকালকে বলেন, টেরিবাজারে হানিমুনের কোনো শাখা নেই। বিপিসির কর্মকর্তাদের আমরা কোনো পোশাক সরবরাহ করিনি।
এদিকে জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে খোদ সংস্থার সচিব মো. লাল মিয়ার বিরুদ্ধেও। চলতি বছরের পোশাক কিনে স্টোরে জমা দেওয়ার কথা উল্লেখ করে একটি বিল জমা দেন তিনি। ভ্যাট বাদ দিয়ে অফিস থেকে ২১ হাজার ৪৪১ টাকা নিয়েছেন তিনি। প্রমাণ হিসেবে বাটা ব্র্যান্ডের জুতা ক্রয়ের রসিদ ও হানিমুন টেইলার্সের রসিদ জমা দেন ওই কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুটি রসিদই ভুয়া। আর পোশাক যেহেতু কেনাই হয়নি, সেই পোশাক ও জুতা কীভাবে তিনি স্টোরে জমা দিলেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এভাবে আরও বেশ কয়েকজনের জমা দেওয়া ভুয়া রসিদ ও টাকা উত্তোলনের কাগজপত্র পাওয়া গেছে। পোশাক না কিনে টাকা নেওয়ার পাশাপাশি দোকানের রসিদ জাল করার মতো জালিয়াতিও করেছেন তারা। আরও অবাক করা বিষয় হচ্ছে, পোশাকের বিষয়টি এড়াতে বিপিসি কর্মকর্তারা কাগজপত্রে বিল নিচ্ছেন অফিস স্টেশনারির নামে। এই সংক্রান্ত কাগজপত্রও এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
এ ব্যাপারে বিপিসির সচিব লাল হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি উল্টো জানতে চান বিপিসির 'গোপন' কাগজপত্র কীভাবে এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। পোশাক কেনার কাগজপত্র, তাও আবার জাল করে বানানো- এ ধরনের কাগজপত্র গোপনীয় কিনা পাল্টা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেটা যেন অনুসন্ধান করেই প্রকাশ করা হয়।' অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার চিত্র তুলে ধরলে একপর্যায়ে ফোনের সংযোগ কেটে দেন তিনি।
এদিকে নিজেদের পোশাক সংগ্রহে বাজারমূল্যের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি মূল্য নির্ধারণ করেছে বিপিসি। পুরুষ ও নারীদের কয়েকটি কাপড়ের দোকান ও টেইলার্সে খোঁজ নিয়ে বাজারমূল্যের সঙ্গে বিপিসির নির্ধারণ করা মূল্যের সামঞ্জস্য পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৪ অক্টোবর বিপিসির এক সভায় গ্রীষ্ফ্ম ও শীতকালীন পোশাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিপিসির তৎকালীন সচিব মো. নুরুল আমিন স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত এক প্রস্তাবে বিপিসি কর্মকর্তাদের মনঃকষ্টের কথা তুলে ধরা হয়। এরপর থেকেই স্যুট-কোটসহ বিনা পয়সায় কাপড় পাচ্ছেন তারা।

আরও পড়ুন

×