রূপে-গুণে অনন্য ফলসা

ফলসার ফল -লেখক
মোকারম হোসেন
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ২১:০৮ | আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ২১:০৮
ফলসা আমাদের কাছে বুনোফল হিসেবেই পরিচিত। গ্রামে একসময় প্রচুর পরিমাণে দেখা গেলেও ইদানীং বেশ দুর্লভ হয়ে উঠেছে গাছটি। মাত্র কয়েক দশক আগেও পথের ধারে বা পতিত জায়গায় আপনাআপনিই জন্মাত। প্রকৃতিতে বীজ ছড়িয়ে দেবার কাজটি করত পাখিরা। কারণ, এই ফল শিশুদের পাশাপাশি পাখিদেরও অনেক প্রিয়। শহরে এ গাছ খুঁজে পাওয়া অনেকটা সৌভাগ্যের ব্যাপার।
পাখিদের মধ্যে সম্ভবত কাকই এ ফল সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। ফলসা পাকার মৌসুমে সারাদিনই ওদের আনাগোনা চোখে পড়ে। হয়তো আরও অনেক প্রাণী এ ফল খেয়ে বেঁচে থাকে। তবে শুধু ফলের কথা বাদ দিলেও ফলসা গাছ পাতা ও ফুলের সৌন্দর্যেও অনন্য।
ফলসা গাছ চিনেছি অনেক পরে। প্রায় দুই দশক আগে গাজীপুরের শালনায় অবস্থিত 'শালনা অরচ্যার্ড'-এ গাছটি প্রথম দেখি। বাগানটির স্বত্বাধিকারী 'মূলধারা একাত্তর'খ্যাত মঈদুল হাসান বেশ আগ্রহ নিয়ে তখন গাছটি চেনালেন। দেখালেন মটরদানার মতো ছোট ফলগুলো। পরে অবশ্য ঢাকায় রমনা পার্ক, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান ও ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টারে কয়েকটি গাছ দেখেছি।
ফলসা অনেকেই চেনেন না। কিংবা কুলীন ফল নয় ভেবে এড়িয়ে যেতে চান। কিন্তু গাছটি একেবারেই আমাদের নিজস্ব। ভারত উপমহাদেশ তার আদি আবাস। অথচ এখন আমাদের চারপাশ থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। নগর প্রকৃতিতে এই প্রবণতা আরও প্রকট। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় এখনও অল্পসল্প চোখে পড়ে।
ফলসা (Grewia asiatica) মাঝারি আকৃতির পত্রমোচি গাছ। সাধারণত ৫ থেকে ৭ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। পাতা ডিম্বাকার, খসখসে, রোমশ ও কিনারা দাঁতানো। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হালকা হলদে রঙের ফুল ফোটে মার্চ-এপ্রিলে। ফল পাকে মে-জুন মাসে। দেখতে মটরদানার মতো, গোলাকার। কাঁচা রং সবুজ, স্বাদে টক। পাকলে কালচে বাদামি রঙের মনলোভা রূপ ধারণ করে। খেতে টক-মিষ্টি স্বাদের। রস গরমে ক্লান্তিনাশক, তা ছাড়া স্কোয়াশ ও অন্যান্য কোমল পানীয় তৈরিতেও কাজে লাগে। প্রতি ১০০০ গ্রাম ফল থেকে ৭২৪ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। মিয়ানমারে গাছের বাকল সাবানের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবার বাকলের আঠালো উপাদান খাদ্যদ্রব্য শোধনেও কাজে লাগে।
ফলসায় রয়েছে আরও অনেক খাদ্যগুণ। বাতের ব্যথার সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই ফলসা খেয়ে থাকেন। এই ফলে থাকে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণ, যা বাতের ব্যথার কারণে পায়ের গিঁট ফুলে যাওয়া ও ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। এই ফলে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস। এই উপাদানটি আমাদের শরীরে অ্যান্টি ক্যান্সার এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। ফলের রসে থাকে লো-গ্লাইসেমিক ইনডেক্স। এটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ফলসায় থাকা ফাইটোকেমিক্যালস উপাদান শ্বাস সম্বন্ধীয় সমস্যার উপশম ঘটায়। এই ফলে থাকা পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম আমাদের হাড় মজবুত রাখতে সাহায্য করে। ফলে পর্যাপ্ত মাত্রায় ফাইবার থাকে, যা আমাদের পেটে ব্যথা হলে দ্রুত উপশমে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডায়ারিয়া প্রতিরোধে ফলসা ফল ও গাছের বাকল অত্যন্ত কার্যকর।
ফলসার পাকা ফল রস করেও খাওয়া যায়। স্বাদ বাড়ানোর জন্য তাতে সামান্য লেবুর রস এবং পুদিনা পাতাও যোগ করা যায়। শরবতের সঙ্গে সামান্য পরিমাণে গোলাপ ফুলের পাপড়িও মেশানো যেতে পারে। আবার স্বাদের ভিন্নতার জন্য ফ্রুট স্যালাডে মিশিয়েও ফলসা খাওয়া যায়। এছাড়া আইসক্রিম, মিষ্টি পাউরুটি কিংবা অন্য কিছু বানানোর জন্য মিষ্টি সিরাপ তৈরি করতেও ফলসা ফল ব্যবহার করা যায়। তবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবসময়ই পরিমিতি থাকতে হবে।
- বিষয় :
- ফলসা
- মোকারম হোসেন