নিরাপদে নেই কন্যাশিশুরা

প্রতীকী ছবি
সাজিদা ইসলাম পারুল
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২১ | ২৩:০৫ | আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২১ | ২৩:২৪
দিনভর এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে বেড়ায় আট বছরের জুঁই (ছদ্মনাম)। প্রতিবেশীরাও সবাই আদর করে তাকে। এমন পরিস্থিতিতে ৫৫ বছর বয়সী এক প্রতিবেশীর ধর্ষণের শিকার হয় সে। চকলেটের লোভ দেখিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করা হয় তাকে। ভয়ে কাউকে বলেনি সে ঘটনাটি। কিন্তু একদিন রাতে তার নানি কাপড়ে রক্তের দাগ দেখে চিন্তিত হন। জানতে চান, কীভাবে রক্ত লেগেছে। এক পর্যায়ে ভয় ও দ্বিধা দূর করে জুঁই পরিবারের সবার কাছে ধর্ষণের শিকার হওয়ার কথা জানায়।
একইভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছে জামালপুর সদরের লক্ষ্মীরচর ইউনিয়নের উত্তরপাড়া গ্রামের দরিদ্র এক কৃষকের পাঁচ বছরের মেয়ে। গত বছরের ২৫ আগস্ট সন্ধ্যায় খালি বাড়ি পেয়ে প্রতিবেশী স্বপন আলীর ছেলে বিজয় (১৪) ও আজিজুল হকের ছেলে আলমগীর (১৭) ছোট্ট শিশুকে ফুসলিয়ে বিজয়দের ঘরে নিয়ে যায়। আশপাশের লোকজন ধর্ষণের বিষয়টি টের পেয়ে এগিয়ে এলে আলমগীর ও বিজয় শিশুটিকে বিছানায় ফেলে দ্রুত পালিয়ে যায়।
বছরের পর বছর ধর্ষণের ঘটনার দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় জুঁইসহ অসংখ্য কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। দিনে দিনে এ ধরনের ঘটনা বেড়ে চলেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর- এই আট মাসে এক হাজার ৮৯ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে; নির্যাতনের শিকার হয়েছে এক হাজার ৪০২ জন। এ বছর শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ১৮৫টি বাল্যবিয়ের ঘটনাসহ ৩৩৮ কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে 'আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস'। 'আমরা কন্যাশিশু : প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হব- ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ব' প্রতিপাদ্যে দিবসটি পালিত হচ্ছে। পৃথিবীজুড়ে লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর প্রথম এ দিবস পালিত হয়। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।
শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করছে, এমন সংগঠনের নেতারা জানান, ধর্ষণের ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে দিন দিন ধর্ষণচেষ্টা, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। করোনাকালে ঘরবন্দি জীবনেও নিরাপদ ছিল না কন্যাশিশুরা। এ সময়ে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার ধরনও ছিল ভয়াবহ।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের তথ্য মতে, গত আট মাসে ৮১৩ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৮ জনকে। বিভিন্ন কারণে হত্যা করা হয়েছে ১৯৩ কন্যাশিশুকে। আর ১৫৬ কন্যাশিশু আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়া বাল্যবিয়ে যেন এক নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংস্থাটির তথ্যমতে, গত বছরের তুলনায় এ সময় ১৩ ভাগ বেশি বাল্যবিয়ে সংঘটিত হয়েছে। ১৩৬টি ইউনিয়নে জরিপ পরিচালনা করেছে এ ফোরাম। এক হাজার ২৫৭ কন্যাশিশুর বাল্যবিয়ের কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়া অলিখিতভাবে এক হাজার ৫৩৫টি বাল্যবিয়ে হওয়ার তথ্য পেয়েছে। সব মিলিয়ে ১৩৬ ইউনিয়নে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে দুই হাজার ৭৯১ কন্যাশিশু।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি সমকালকে বলেন, চলতি বছর কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন, ধর্ষণসহ বাল্যবিয়ের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ, দেশে নৈতিকতার পতন ঘটার পাশাপাশি আইনেরও কোনো প্রয়োগ নেই। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে দিন দিন এ ধরনের অপরাধ বেড়েই চলেছে। তাই সরকারকে আগে বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, করোনাকালে সরকার স্বাস্থ্য খাতে বেশি জোর দেওয়ায় কন্যাশিশুর নিরাপত্তার বিষয়ে নজর দিতে পারেনি। ফলে এ সময় এ ধরনের ঘটনা আরও বেড়েছে। কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন ও ধর্ষণ প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি উভয় উদ্যোগই সমানভাবে প্রয়োজন। সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এসব অপরাধ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।