ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সরেজমিন হাসপাতালের চিত্র

হাড় কাঁপানো শীতে শিশুর সীমাহীন কষ্ট

হাড় কাঁপানো শীতে শিশুর সীমাহীন কষ্ট

শয্যা না পেয়ে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে মেঝেতে চলছে রোগীদের চিকিৎসা - মমিনুল ইসলাম মঞ্জু

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২২ | ১৪:৫১

কথায় আছে, মাঘের শীতে বাঘও কাঁপে। মধ্য মাঘে এসে 'বাঘ কাঁপানো' শীতই টের পাচ্ছে উত্তর জনপদের মানুষ। তিন দিন ধরে উত্তরের জেলাগুলোতে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বইছে। ফলে বেড়েছে শীতজনিত নানা রোগ। বিশেষ করে শিশুদের চলছে 'রাহুর দশা'। তারা ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। বয়স্করাও পড়েছেন বিপদে।

জান্নাতুন পৃথিবীর আলো দেখেছে সবে পাঁচ মাস। তাকে ঘিরেই মা জুলেখার যারপরনাই দুশ্চিন্তা। মাঘের ঠান্ডায় ঘায়েল জান্নাতুনের তুলতুলে শরীর। তাকে পেয়ে বসেছে ডায়রিয়া। কনেকনে শীতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০ নম্বর শিশু ওয়ার্ডের বারান্দার মেঝেতে মাদুর পেতে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুকন্যাকে নিয়ে সারারাত নির্ঘুম জুলেখা। ঠান্ডায় জবুথবু জুলেখা কথাও ঠিকমতো বলতে পারছিলেন না। কেঁপে কেঁপে বলার চেষ্টা করলেন, 'বারান্দার মেঝেতে প্রচণ্ড ঠান্ডা। কোনো কাপড় নাই, কম্বল নাই। বাচ্চার পাতলা পায়খানা। ওয়ার্ডের ভেতরে জায়গা নাই। মশা এক রাতেই বাচ্চাটাকে কামড়ে খেয়ে ফেলছে। দ্যাখছেন না!'

শুধু এক জুলেখা নন, তার মতো এমন শত শত মা-বাবার সন্তানের চিকিৎসা করাতে এসে হাসপাতালের ওয়ার্ডে রাত কাটছে ঘুমহীন। তবুও সন্তানকে সুরক্ষা দিতে শীতের সঙ্গে তাদের দুর্দান্ত লড়াই।

শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সময় শিশুদের পর্যাপ্ত গরম কাপড় পরাতে হবে। ঠান্ডা ও বাসি খাবার দেওয়া যাবে না। ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্টসহ শীতজনিত রোগ দেখা দিলেই দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৪ নম্বর শিশু ওয়ার্ড। এখানে অনুমোদিত বেড সংখ্যা মাত্র ২৬টি। গতকাল রোববার দুপুর ১২টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায় রোগী ভর্তি আছেন ১০৪ জন। শয্যা ও মেঝেতে ঠাঁই নেই। বারান্দার মেঝেতেও রোগীর চাপে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। এই ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স হোসনে আরা বলেন, 'ডায়রিয়া, নিউমোনিয়ার রোগী এখানে বেশি। ওয়ার্ডে জায়গা নেই। তাই মেঝে ও বারান্দায় রোগী আছে।' শুধু ২৪ নম্বর ওয়ার্ড নয়, হাসপাতালের সব শিশু ওয়ার্ডেই এখন শিশু রোগীর চাপ বেড়েছে। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি।

রোগীরা জানান, হাসপাতালের কক্ষে জায়গা নেই। তাই রোগী নিয়ে বারান্দায় থাকতে হচ্ছে। কিন্তু রাতে বারান্দায় প্রচণ্ড ঠান্ডা। এই ঠান্ডায় শিশুদের বেশ কষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া মশার কামড়ে শিশু ও অভিভাবকরা অতিষ্ঠ।

বাগমারা থেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে ভর্তি আছেন রাবেয়া। তিনি বলেন, 'ওয়ার্ডের ভেতরে জায়গা নেই। তাই বারান্দায় থাকতে দিয়েছে। বারান্দায় মেলা ঠান্ডা। তাই বাচ্চার সঙ্গে আমরাও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি।'

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, '১২০০ শয্যার হাসপাতালে প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোগী থাকছে। তাদের সুচিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে জায়গা নেই। সংকট সমাধানের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আপাতত বারান্দাগুলোতে থাইগ্লাস দিয়ে ঢেকে ঠান্ডা থেকে রোগীদের বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। শিগগিরই তা হয়ে যাবে।'

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: রোগী ও অভিভাবকের ভিড়ে ওয়ার্ড ওয়ার্ডে শোরগোল। শয্যা সংকটের কারণে মেঝেতেও অনেক রোগী। এক শয্যায় চিকিৎসা নিচ্ছে তিন শিশু। ভিড় ঠেলে চিকিৎসক ও নার্সরা দিচ্ছেন চিকিৎসা। উত্তরে শীত বেড়ে যাওয়ায় কয়েক গুণ রোগী বেড়েছে হাসপাতালে। তাই শয্যা ফাঁকা না থাকায় নতুন রোগীদের পুরোনো রোগীর সঙ্গে একই বেডে দেওয়া হচ্ছে। ফলে রোগী, অভিভাবক, চিকিৎসক, নার্সসহ সবাইকে চিকিৎসাসেবা নিতে ও দিতে রীতিমতো 'যুদ্ধ' করতে হচ্ছে। এমনই ছবি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৯ ও ১০ নম্বর ওয়ার্ডের শিশু বিভাগে। নবজাতক নিয়ে এক সপ্তাহ আগে শিশু বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসেছেন নীলফামারীর সৈয়দপুরের বাসিন্দা গুড়িয়া (৩৫)। খালি শয্যা না থাকায় পুরোনো রোগীর সঙ্গে তার নবজাতকের চিকিৎসা চলছে। তিনি বলেন, একই শয্যায় তিনটি শিশুকে একসঙ্গে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে পুরো ওয়ার্ডে মানুষে গিজগিজ করছে। অতিরিক্ত মানুষের কথা বললে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, পছন্দ না হলে এখান থেকে চলে যেতে। গরিব মানুষ হওয়ায় উপায় না পেয়ে এখানেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।

শিশু বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. মো. ফখরুল আলম বলেন, 'শীত বেড়ে যাওয়ায় শিশু বিভাগে রোগী ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমরা সাধ্যমতো চিকিৎসাসেবা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘন্টায় ৯ নম্বর শিশু ওয়ার্ডে ৩২ শয্যার বিপরীতে ৭০ জন, ১০ নম্বর ওয়ার্ডে ৪০ শয্যার বিপরীতে ১০৫ জন শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মো. মোকারম হোসেন বলেন, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি ১০০ শয্যার হলেও আমরা এর দ্বিগুণ রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি। বিশেষ করে শিশু ও মেডিসিন বিভাগে অত্যধিক রোগীর চাপ।

কুড়িগ্রামের জেনারেল হাসপাতাল: কুড়িগ্রামের জেনারেল হাসপাতালেও গিজগিজ করছে রোগী। শয্যা সংখ্যার চেয়ে রোগী বেশি হওয়ায় প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে শিশুসহ অনেক রোগীকে।

উলিপুরের বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের মৃত আজাহার আলীর স্ত্রী জাহিরন বেওয়া (৬০) কাশি ও বুকে ব্যথা নিয়ে জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯ দিন আগে। হাসপাতালের অপারেশন কক্ষের এক পাশে মেঝেতে শয্যা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ছেলে এরশাদ জানান, রাতে ঠান্ডা বাতাসের কারণে বাইরে শয্যা পেতে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তার মা কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও ঠান্ডা বাড়ার কারণে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

শিশু ওয়ার্ডের প্রবেশপথে শয্যা পেতে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত দেড় বছর বয়সী শিশু সুরাইয়ার দেখভাল করছিলেন কুড়িগ্রামের সদরের হরিকেশ গ্রামের খুশি বেগম। রোববার সকাল ১১টার দিকে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কোনো চিকিৎসক তার মেয়েকে দেখে যাননি বলে অভিযোগ করেন খুশি বেগম।

ফুলবাড়ীর সদর ইউনিয়নের মিলন মিয়া (৩৫) হাসপাতালের বারান্দায় বেঞ্চে বসে উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনরাত কাটছে তার। ঠান্ডার কারণে চার দিন ধরে তার নবজাতককে হিট দিয়ে রাখা হচ্ছে। দুইবেলা চলছে ইনজেকশন।

শুধু শিশু ওয়ার্ড নয়, ১২ শয্যার ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি আছে ৪০ জন। এর মধ্যে ৩৯ জনই শিশু। ওয়ার্ডের ভেতরে ঢোকার মতো কোনো কায়দা নেই। গাদাগাদি করে বিছানা এবং মেঝেতে রোগীরা আছেন।

জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শহিদুল্ল্যাহ জানান, রোগীর উপচে পড়া ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এই হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও জনবল কাঠামো ১০০ শয্যার রয়ে গেছে। সেই কাঠামো অনুযায়ী জনবল নেই। মোট ৪৩ জন চিকিৎসকের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ১৭ জন।

গত ২৪ ঘন্টায় এই হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন ১০৯ জন। এর মধ্যে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ২০ জন এবং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত দু’জনসহ মোট ২২ জন শিশু ভর্তি হয়েছে। এ নিয়ে রোববার ভর্তি ছিল ২৮৭ জন। এদের মধ্যে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৩৯ জন এবং শিশু ওয়ার্ডে নবজাতকসহ ৫৮ জন মোট ৯৭ জন শিশু রয়েছে।

পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতাল: প্রতিদিন পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের শুধু শিশু ওয়ার্ডেই ২৫ থেকে ৩০ শিশু শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছে। হাসপাতালে শিশু রোগীদের স্থান সংকুলান হচ্ছে না। এর বাইরেও প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ রোগী হাসপাতালের বহির্বিভাগে শীতজনিত রোগের চিকিৎসা নিচ্ছেন। গত বৃহস্পতিবার বোদার ময়দানদীঘি এলাকার সাবিহা সাবা নামে ৩৩ মাস বয়সী এক শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহে শীতজনিত রোগে আত্রান্ত হয়ে শিশু ওয়ার্ডে ১৬২ জন ভর্তি হয়েছে। রোববার দুপুর পর্যন্ত নতুন করে ভর্তি হয়েছে ২৬ শিশু। এর বাইরে পুরুষ ও নারী ওয়ার্ড ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগে শীতজনিত বয়স্ক রোগীরা ভর্তি হচ্ছেন। একই অবস্থা জেলার পাঁচ উপজেলার বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও।

সদর উপজেলার অমর খানা ইউনিয়নের মডেলহাট এলাকার ওসমান গনির স্ত্রী মালেকা বেগম তার এক মাস বয়সী শিশুকে ডায়রিয়া ও পেট ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। তিনি বলেন, তিন দিন ধরে এখানে আছি। এখন চিকিৎসা নিয়ে বাচ্চা কিছুটা ভালো।

পঞ্চগড়ের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. আফরোজা বেগম রীনা বলেন, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা বেশি সর্দি, জ্বর, নিউমোনিয়া আর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন।

শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, সময়মতো হাসপাতালে নিয়ে না আসার কারণে গত বৃহস্পতিবার এক শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। তবে অসংখ্য শিশু হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে।

আরও পড়ুন

×