ইউপির ষষ্ঠ ধাপে শান্তিপূর্ণ ভোট
নৌকার সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর টক্কর

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২২ | ২০:৫২
ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের ষষ্ঠ ধাপেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। গতকাল সোমবার ২১৮টিতে ভোট হলেও রাত দেড়টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সমকাল প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে ১৫৪টির ফল পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা জিতেছেন ৮৭টি ইউনিয়নে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৬৫টিতে। স্বতন্ত্রদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী রয়েছেন ২৮টিতে। কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপির স্থানীয় নেতারা স্বতন্ত্র পরিচয়ে ২০টিতে, জাতীয় পার্টি দুটিতে ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা জিতেছেন দুটিতে।
এর আগে সংঘাত ও সহিংসতার আশঙ্কা থাকলেও অনেকটাই শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ ভোটের ষষ্ঠ ধাপ। তবে আগের ধাপগুলোর মতো এবারও ভোটে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ভোটের দিন প্রাণহানির খবর পাওয়া না গেলেও আগের দিন রোববার নরসিংদীতে দু'পক্ষের সংঘর্ষে দু'জন নিহত হয়েছেন। গতকাল ভোটের দিন কুমিল্লার মুরাদনগরে দু'পক্ষের সংঘর্ষে ২৩ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চারটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়।
বিএনপির বর্জনের মধ্যে এবার ইউপি ভোটের শুরু থেকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের টক্কর চলছিল। প্রথম ধাপে নৌকার প্রার্থীরা এগিয়ে থাকলেও ব্যবধান কমতে কমতে চতুর্থ ধাপে প্রায় সমান হয়েছিল। কিন্তু পঞ্চম ধাপে এসে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নৌকাকেও ছাড়িয়ে যান। করোনা মহামারির মধ্যে ২১ জুন অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের প্রথম পর্বের ভোটে ২০৪টি ইউপির মধ্যে ১৪৮টিতে নৌকা ও ৪৯টিতে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীরা জয়ী হন। দ্বিতীয় পর্বে ২০ সেপ্টেম্বরে নৌকা জেতেন ১১৯ জন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন ৩৬ জন। প্রথম ধাপে সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের ২৬৭ জন এবং স্বতন্ত্র ৮৫ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ৮৩৪টি ইউপির মধ্যে নৌকা জয় পায় ৪৮৬টিতে এবং ৩৩০টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হন। ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত তৃতীয় ধাপে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয় পান ৫২৫টিতে, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হন ৪৪৬টিতে। ২৬ ডিসেম্বর চতুর্থ ধাপে ৭৯৬ ইউপিতে ভোট হয়। তাতে আওয়ামী লীগের ৩৯৬ প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন, স্বতন্ত্র প্রার্থী জেতেন ৩৯০ ইউনিয়নে। পঞ্চম ধাপে আওয়ামী লীগ জিতেছে ৩৪১টিতে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৩৪৬টিতে।
প্রতি ধাপেই নৌকা প্রতীকে বিজয়ীদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে একটা বড় অংশই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন।
সোমবার ইউপি ভোটের ষষ্ঠ ধাপে দেশের ২২ জেলার ৪২ উপজেলার ২১৮ ইউপিতে ভোট নেওয়া হয়। এর মধ্যে ২১৬ ইউপিতে ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) এবং মাত্র দুই ইউপিতে ব্যালটে ভোট হয়। ইভিএমের কারণে ভোট গ্রহণে ধীরগতি ও অনেক ভোটার ভোট না দিয়ে কেন্দ্র ছেড়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। ভোট গ্রহণ শেষে ঢাকায় ইসি কার্যালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন কবির খোন্দকার জানিয়েছেন, দেশে প্রচণ্ড শীত পড়ার কারণে ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে। এই ধাপে ৫৫ শতাংশ ভোট পড়তে পারে বলে তিনি মাঠ পর্যায় থেকে ধারণা পেয়েছেন।
গতকাল সোমবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট নেওয়া হয়। গত পাঁচ মাসে নির্বাচনী সংঘাত ও হানাহানিতে সারাদেশে অন্তত ১০০ জন নিহত হয়েছেন। নির্বাচনী সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে। এ দুই ধাপেই অর্ধশতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। করোনা সংক্রমণের কারণে প্রথম ধাপে দুই ভাগে নির্বাচন হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগের নির্বাচন হয়েছে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। তখন থেকেই সারাদেশে নির্বাচন পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে উঠতে দেখা যায়।
গতকাল কেন্দ্র দখলের অভিযোগ এনে চট্টগ্রামের আনোয়ারার জুঁইদণ্ডী ইউপির নির্বাচন বর্জন করেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী রাশেদুল ইসলাম চৌধুরী। সকাল পৌনে ১০টায় নিজের বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন তিনি।
এদিকে, কুড়িগ্রামের চিলমারীর অষ্টমীর চর ইউনিয়নে গতকাল সন্ধ্যায় একটি ভোটকেন্দ্রের ফল ঘোষণার পর প্রিসাইডিং অফিসার শাখাওয়াত হোসেনের ওপর হামলা হয়েছে। এক ইউপি সদস্যের সমর্থকরা বাঁশের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে দেয়। আহত কর্মকর্তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও নবীনগর দুই উপজেলার দুটি কেন্দ্রে ইভিএমের কারিগরি ত্রুটির কারণে ভোট গ্রহণ শুরু হতে দেরি হয়েছে।
ঢাকার দোহারের বিলাশপুর ইউপি নির্বাচনে মাঝিরকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ওই ইউপির একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনী এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। নোয়াখালীর সেনবাগের নবীপুরের দুটি কেন্দ্র দখলের চেষ্টা হয়েছে। এ ঘটনায় সিল মারা ৪৭টি ব্যালট পেপার বাতিল করা হয়েছে।
শীতের তীব্রতায় ভোটার উপস্থিতি কম- ইসি সচিব :দেশে প্রচণ্ড শীত পড়ার কারণে ষষ্ঠ ধাপের ভোটে গতকাল সোমবার ভোট পড়ার হার কম বলে জানিয়েছেন ইসি সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার। ভোট গ্রহণ সুষ্ঠু এবং সুন্দর পরিবেশে শেষ হয়েছে দাবি করে ইসি সচিব বলেন, ইভিএমের কারণে ভোট গ্রহণে ধীরগতি ছিল। এতে ভোট কম পড়েছে। ৫৫ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে। তিনি বলেন, দেশে প্রচণ্ড শীত পড়েছে, তার কারণেও ভোট পড়ার হার কম হতে পারে।
মাঠ পর্যায় থেকে পাওয়া তথ্যের উদ্ৃব্দতি দিয়ে তিনি বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কোনো অপ্রীতিকর খবর তারা পাননি। সুষ্ঠু এবং সুন্দর পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। কোনো কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়নি।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্নিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা]