'অর্ধভাষী' হয়ে উঠছে শিশু কিশোররা

সাজিদা ইসলাম পারুল
প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৪:৩৯
'হাঁস ছিল সজারু, ব্যাকরণ মানি না। হয়ে গেল হাঁসজারু, কেমনে তা জানি না।' নতুন প্রজন্মের মধ্যে ভাষা প্রয়োগ, ব্যবহার ও উচ্চারণের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভাষার মিশ্রণ ও শব্দের বিকৃত উপস্থাপনে অর্ধভাষীরা মূলত শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়ের এই 'খিচুড়ি' কবিতার মতোই। এ সময়ে এসে ছড়ার 'হাঁসজারু' হয়ে উঠেছেন অনেক তরুণ শিক্ষার্থী ও বেসরকারি রেডিও চ্যানেলের উপস্থাপকরা। তারা নিত্যদিনের কাজকর্মে চলাফেরায় বাংলা-ইংরেজি বা বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি মিশ্রিত বিকৃত শব্দ উচ্চারণ করছেন। ভাষা বিশ্নেষকরা বলছেন, এসব 'বাংলিশ' বা অর্ধভাষী শব্দ প্রয়োগের প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। এভাবে চলতে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে বাংলা ভাষার মৌলিকতা ও অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে অনেক অভিভাবক জোর করে তাদের সন্তানদের ইংরেজি শেখাচ্ছেন। এর ফলে বর্তমান প্রজন্ম বাংলাও শিখছে না, ইংরেজিও শিখছে না। দ্বিভাষী না হয়ে তারা 'অর্ধভাষী' হয়ে উঠছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস সমকালকে বলেন, বাংলা বলতে গিয়ে ইংরেজি বলা কিংবা উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার বিকৃত উপস্থাপনের একটা বিচিত্র প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে 'অর্ধভাষী' প্রবণতা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে গেছে। এভাবে কথা না বললে যেন তাদের মর্যাদাই থাকে না।
তিনি বলেন, বাংলা ভাষা ব্যবহারে সকলকে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে শব্দের বানান ও উচ্চারণ সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে। শিক্ষণের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রথম দায়িত্ব পরিবারের লোকজনের। তবে স্কুল পর্যায়েই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের শব্দের বানান ও উচ্চারণ শেখাতে হবে। তবেই এই জায়গা থেকে তরুণরা বেরিয়ে আসতে পারবে।
শিশুদের ওপর প্রভাব: ইন্টারনেটের বদৌলতে তিন বছর বয়স থেকেই বাবার মোবাইলে হিন্দি কার্টুন দেখছে সানজানা। বাংলা ভাষার বদলে দ্রুতই তার আয়ত্তে চলে আসে হিন্দি ভাষা। 'মা, মুঝে এক চকলেট খিলা দো', 'কেয়া হুয়া', 'মুঝে বল দে দো', 'মা কুছ ইন্তেজার কারো..' ছোট্ট সানজানার টানা হিন্দি ভাষার ব্যবহার পরিবারের সবাইকে চিন্তায় ফেলে দেয়। পরবর্তীকালে হিন্দি ভাষার পাশাপাশি সে বাংলা ভাষায় কথা বলাও শুরু করে।
রাজধানীর দক্ষিণখানের এক দম্পতির ৫ বছর ও ১১ বছর বয়সী দুই মেয়ে। দিনের অধিকাংশ সময়ই মায়ের মোবাইলে ইউটিউবে কোরিয়ান ভাষায় তৈরি কার্টুন, নাচ ও গান দেখে তারা। এক পর্যায়ে দেখা যায় বাংলার পরিবর্তে তারা কোরিয়ান ভাষায় গান গাইতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এমনকী ভাঙাচোরা কোরিয়ান ও হিন্দি ভাষায় কথাও বলে তারা।
শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সময়ে পাঁচ বছরের শিশু থেকে ১২ থেকে ১৩ বছরের শিশুরা অস্বাভাবিকভাবে ঝুঁকে পড়ছে হিন্দির দিকে। ভিন্ন ভাষা জানা বা শেখা দোষের কিছু না হলেও জীবনের পরতে পরতে হিন্দি, কোরিয়া, ইংলিশ ভাষার ভাঙাচোরা ব্যবহার ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে শিশুদের ওপর।
অনেকে বলছেন, 'টম অ্যান্ড জেরি', 'মিকি মাউস', 'পাপাই দ্য সেইলর', 'বাগস বানি' কার্টুনগুলো শিশুদের নির্মল আনন্দ দিলেও তাদের মস্তিস্কে ঢুকিয়ে দিচ্ছে এই ভাঙাচোরা ভাষা।
সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক শারমীন নাহার বলেন, ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে গর্বিত যে জাতি, তার জন্য এটি বড় বেদনার। তিনি বলেন, বাংলা ভাষার প্রচলিত ধারাকে যেন বিকৃত করা না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামী ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন ও অমর একুশে এক মহান সংযোজন। একুশের পথ বেয়েই মাতৃভাষা বাংলা এসেছে।
দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক সমকালকে বলেন, 'ভাষা মিশ্রভাবে ব্যবহার করা ভালো নয়। স্বাস্থ্যকর নয়। কেউ ইংরেজি ভাষায় কথা বলা প্রয়োজন মনে করলে ইংরেজিতেই বলুক। কিন্তু মাতৃভাষা বাংলা হওয়ায় আমাদের বাংলা ভাষাতেই কথা বলতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, প্রমিত বাংলা শব্দের বানান এবং উচ্চারণ সুনির্দিষ্ট। বাংলা ভাষাকে মিশ্রিত বা বিকৃত করে বলার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সর্বোপরি সরকারকে বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।