কামরুল-হ্যারির হাত ধরে ঢাকায় আসে ক্যাসিনো

আতাউর রহমান ও বকুল আহমেদ
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ১৩:৪০ | আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ১৩:৪০
রাজধানীর আরামবাগের একসময়ের বড় ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম জুয়া খেলতেন
ক্লাবগুলোতে। ক্যাসিনো খেলতে যেতেন নেপাল, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন
দেশে। এর সূত্র ধরেই নেপালি নাগরিক হ্যারির সঙ্গে পরিচয় তার। হ্যারি নিজেও
জুয়ার বিশেষজ্ঞ। তবে তিনি নিজে খেলেন না, অন্যকে দিয়ে খেলান। নেপালে তিনি
ক্যাসিনো বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। কামরুলের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে হ্যারির
হাত ধরে প্রথম ঢাকায় আসে ক্যাসিনো সরঞ্জাম। ২০১৬ সালের শেষের দিকে
প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় মতিঝিলের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে বসানো হয়
ক্যাসিনো। এরপরই যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পান যুবলীগের কয়েকজন নেতা। তারা
ঝুঁকে পড়েন কামরুল আর হ্যারির দেখানো পথে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও মতিঝিলের
ক্লাবপাড়ার সংশ্নিষ্ট সূত্রে মিলেছে এসব তথ্য।
সূত্র বলছে, নেপালি নাগরিক হ্যারি গত তিন বছরে বারবার বাংলাদেশে এসেছেন।
কামরুলের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে তিনি এদেশে ক্যাসিনো সরঞ্জাম এনে তা
ক্লাবগুলোতে স্থাপন করেছেন। এগুলো চালাতে নিজেই নেপালিদের বাংলাদেশে নিয়ে
আসেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর মতিঝিল এলাকায় ক্যাসিনোতে অভিযান চালানোর সময়ে তিনি
মতিঝিল এলাকায় ছিলেন। এরপরই আত্মগোপনে চলে যান। গত রোববার পর্যন্ত তিনি
বাংলাদেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে।
অন্যদিকে যে কামরুলের হাত ধরে ঢাকায় ক্যাসিনো সরঞ্জাম স্থাপন করা হয়েছে,
ক্যাসিনো খেলে সেই কামরুলও এখন নিঃস্ব। সব সম্পদ হারিয়ে তিনি ক্লাবপাড়াতেই
থাকতেন।
তবে র্যাবের অভিযানের মুখে আত্মগোপনে চলে গেছেন। সর্বশেষ তিনি বিভিন্ন
জুয়াড়ির দেওয়া ৫০০ টাকা ১০০০ টাকার অনুদানে ক্যাসিনো খেলতেন। আইন-শৃঙ্খলা
বাহিনীর সদস্যরা এখন তাদের হন্যে হয়ে খুঁজছেন।
সূত্রগুলো বলছে, কামরুলের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, প্রভাবও নেই। ক্যাসিনো
স্থাপনে শুধু তাকে ব্যবহার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ
থেকে বহিস্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও পলাতক ওয়ার্ড
কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ ব্যবহার করেছেন তাকে। এ ছাড়া কামরুলকে ব্যবহার
করে কোটিপতি হয়েছেন পুরান ঢাকার তিন ভাই রশীদুল হক ভূঁইয়া, এনামুল হক ওরফে
এনু ভূঁইয়া এবং রুপন ভূঁইয়া।
র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফীউল্লাহ বুলবুল সমকালকে বলেন, 'আগের
অভিযানগুলোর পর আমরা পুরো বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছি। অনেক তথ্য এবং অনেকের
নামই বেরিয়ে আসছে। তদন্ত পর্যায়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।'
ক্যাসিনোকাণ্ডের ঘটনাগুলোর তদন্তের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন,
হ্যারির নেতৃত্বে নেপালি একটি গ্রুপ ঢাকায় ক্যাসিনো বসালেও ঢাকার কিছু
পেশাদার জুয়াড়ি এতে সহায়তা করে। তাদের শেল্টার দেন যুবলীগের কয়েক নেতা।
তারা সব দিক ম্যানেজ করে ক্লাবে ক্যাসিনো কারবার স্বাভাবিকভাবে চালাতে
সহায়তা করেন। এতে নেতাদের কেউ দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে মোটা
অঙ্কের টাকা পেতেন। ক্লাব সংশ্নিষ্ট কিছু অসাধু কর্মকর্তাও মোটা অঙ্কের
টাকা পেয়ে অবৈধভাবে স্পোর্টিং ক্লাবগুলোকে ক্যাসিনো বসাতে সহায়তা করেন।
তদন্তে পাওয়া সবার নাম তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্লাবপাড়ার সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, প্রভাবশালী
নেতাদের নির্দেশে ঢাকায় আরও অন্তত ১০টি ক্যাসিনো বসানোর পরিকল্পনা ছিল
নেপালি নাগরিক হ্যারির। এতে সহায়তা দিয়ে আসছিল পুরান ঢাকার গে ারিয়ার রশীদ
ভূঁইয়া, এনামুল হক এনু ভূঁইয়া ও রুপন ভূঁইয়া নামের তিন ভাই। র্যাব তাদের
বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পাঁচ কোটি টাকা উদ্ধারের পর তারাও আত্মগোপনে রয়েছে।
এর বাইরে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনোর অংশীদার হিসেবে করিম, মোবারক ও
সানি নামে আরও তিনজন রয়েছে। তাদের হয়ে পাভেল সবকিছু দেখভাল করত। তবে তারা
সবাই পলাতক।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে, এনামুল ভূঁইয়াদের বাবা সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়া
নব্বইয়ের দশকে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের দারোয়ান ছিলেন। ক্লাবে চলা জুয়ার
বোর্ডের সদস্যরা তাকে ২০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ টাকা বকশিশ দিতেন। ওই সময়ে
ক্লাবগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল আরামবাগের নাসির নামে এক সন্ত্রাসীর হাতে। নাসির
এসব ক্লাব থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিতেন। তার কাছ থেকে কিছু টাকা পেতেন
সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়া। এক পর্যায়ে নাসির খুন হয়ে গেলে ওই মামলায় সিরাজুল
ভূঁইয়া কয়েক বছর জেলও খাটেন। কারাগার থেকে বেরিয়ে নিজেই জুয়ার নিয়ন্ত্রণ
নেন। তার হাত ধরেই তার ছেলেরা প্রথমে হাউজি জুয়ার দেখভাল শুরু করে। এক
পর্যায়ে তারা ক্যাসিনো মালিক বনে যায়।
লোকমান ভূঁইয়া ও ফিরোজ ফের রিমান্ডে :মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পরিচালক ও
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া এবং
কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি সফিকুল আলম ভূঁইয়া ফিরোজকে ফের রিমান্ডে
নেওয়া হয়েছে। গতকাল তাদের পৃথক আদালতে হাজির করে লোকমান ভূঁইয়াকে দু'দিনের
রিমান্ডে নেওয়া হয় এবং ফিরোজকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, লোকমানের দু'দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল তাকে
আদালতে হাজির করে ফের পাঁচ দিনের রিমান্ড চান তদন্তকারী কর্মকর্তা তেজগাঁও
থানার এসআই কামরুল ইসলাম। মাদক আইনে দায়ের করা মামলায় উভয়পক্ষের শুনানি
শেষে জামিন আবেদন নাকচ করে দু'দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন হাকিম। এর আগে ২৭
সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম তার দু'দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন। গত ২৫
সেপ্টেম্বর বিপুল পরিমাণ মদসহ র্যাব তাকে গ্রেফতার করেছিল। এর আগে ২০
সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হয়েছিলেন ফিরোজ।
- বিষয় :
- ক্যাসিনো