ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

‘ভালো কাজের হোটেল’

ভালো কাজ করলে বিনাপয়সায় মিলছে খাবার

ভালো কাজ করলে বিনাপয়সায় মিলছে খাবার

ভালো কাজের হোটেলের ব্যানার, ভিডিও থেকে নেওয়া

রাজীব আহাম্মদ

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২২ | ০৮:৫৫ | আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২২ | ০৯:০৮

‘ভালো কাজের হোটেল’। এখানে খাওয়া-দাওয়া করতে টাকা লাগে না। দিনে একটি ভালো কাজ করার বিনিময়েই এই হোটেলে খাবার পাওয়া যায়। সোমবার বিকেলে তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড়ের আগে ভূমি জরিপ ভবনে পাশে ‘হোটেলটির’ দেখা মিলল। দেয়ালে ঝুলানো একটি ব্যানার, দুটি ক্যারেটে শখানেক ডিম, মোরগ-পোলাওয়ের প্যাকেট আর দুটি ড্রামের একটিতে শরবত অন্যটিতে পানি। এই নিয়ে ভাল কাজের হোটেল।

দুই কিশোর ফুটপাতে খাবার নিয়ে বসে ছিল ‘ক্রেতার’ অপেক্ষায়। তাদের একজন বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র মো. হা-মীম। অন্যজন কমলাপুর সরকারি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মো. ইমন। যে এসে বলবে, আজ সে একটি ভালো করেছে, তাকেই খাবার দেবে এই দুই কিশোর। তাকে ইফতার করাবে।

কিন্তু ভালো কাজের সংজ্ঞা কী? তাও জানা গেল দুই কিশোরের কাছে। হা-মীম বলল, পরিশ্রমও একটি ভালো কাজ। কেউ যদি সারাদিন রিকশা চালাল বা অন্য কোনো পরিশ্রমের কাজ করেন, তাকেও খাবার দেওয়া হয়। শুধু এসে বললেই হবে। ভালো কাজের হোটেলের স্বেচ্ছাসেবকরা বিশ্বাস করে তাদের আপ্যায়ন করে।

হা-মীম বলল, ২০১৯ সাল থেকে চলছে এই ভাল কাজের হোটেল। ঢাকার কমলাপুর স্টেশন এলাকায় প্রধান শাখা। তেজগাঁও, বনানী ১১ নম্বর বস্তি এবং চট্টগ্রামে বাকি তিন শাখা। প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৭০০ মানুষকে খাওয়ানো হয়। কমলাপুরেই মূল আয়োজন।

কথা বলতে বলতে ক্রেতাদের ভিড় শুরু হয় হোটেলে। তারা এসেছেন ইফতারের সন্ধানে। বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, তরুণ, শিশু সবাই আছেন ক্রেতার লাইনে। কথা হল বয়োবৃদ্ধ শমসের আলীর সঙ্গে। তিনি এফডিসি রেলগেটের পাশে রিকশা সারাইয়ের কাজ করতেন। বয়স হয়ে গেছে বলে এখন আর কাজ করতে পারেন না। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। স্ত্রী গত হয়েছেন অনেক দিন। ফুটপাতেই থাকেন শমসের। চেয়েচিন্তে খান। তিনি বললেন, প্রথম রোজা থেকে ইফতার দিচ্ছে ভাল কাজের হোটেল। আগে হাতিরঝিলে রোজ দুপুরের খাবার দিত।



আজানের সময় যত গড়াতে থাকে হা-মীম, ইমনদের ব্যবস্তা বাড়তে থাকে। ছোট্ট দুটি ছেলের তখন রাজ্যের কাজ। ক্রেতাদের সবাইকে লাইন করে বসানো, সবাইকে খাবারের প্যাকেট, পানি, শরবত দিতে হচ্ছে সুশৃঙ্খলভাবে।

যে শহরের বাবা-মা ছেলেকে খেলতে পর্যন্ত দেয় না, পড়ার ক্ষতি হবে বলে, সেই শহরে হা-মীম, ইমনরা কীভাবে ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে’! ইমম বলল, তার বাবা পেশায় বাবুর্চি, মা গৃহিনী। তারা কখনও বাধা হননি। বরং উৎসাহ দিচ্ছেন আর্তের সেবা করতে।

হা-মীম জানাল, ভালো কাজের হোটেলে হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। তারা প্রতিদিন ১০ টাকা করে জামায়। মাসে একসঙ্গে ৩০০ টাকা হোটেলকে দেয়। হা-মীম, ইমন তো স্কুলের ছাত্র। তারা কোথায় দান করার টাকা পায়। ইমন বলল, বাসা থেকে টিফিন ও হাত খরচের জন্য যে টাকা পায়, তা থেকে বাঁচিয়ে দান করে। হা-মীমও একই কায়দায় নিজের শখ পূরণ না করে গরিবের মুখে আহার তুলে দিতে প্রতি মাসে চাঁদা দিচ্ছে।

ফোনে কথা হয় ভালো কাজের হোটেলের উদ্যোক্তাদের একজন জ্যেষ্ঠ স্বেচ্ছাসেবক সাকিব হাসান শাওনের সঙ্গে। তিনি রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায় রয়েছেন। শাওন জানালেন, সাধারণ সময়ে স্বেচ্ছাসেবক ছাড়া কারও কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয় না। তবে রোজায় সাধারণ মানুষের দান গ্রহণ করা হচ্ছে।

শাওন জানালেন, ২০১১ সালে তাদের কার্যক্রম শুরু হলেও হোটেল চলছে দুই বছর ধরে। ছিন্নমূল, ভাসমান মানুষকে খাওয়ানো হয়। এখন ‘ভালো কাজের হাসপাতাল’ও শুরু হয়েছে। প্রতি শনিবার রাতের খাবারের পর কমলাপুর স্টেশনে রোগী দেখা হয়। যাদের হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই, তাদের চিকিৎসা হয়। স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে যারা চিকিৎসক তারাই রোগী দেখেন। ‘ডেইলি টেন স্কুল’ নামে বিদ্যালয়ও শুরু হয়েছে রাজধানীর বাড্ডা, বাসাবো এবং মাদারীপুরে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা এর শিক্ষার্থী। শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। আর দশটি সাধারণ বিদ্যালয়ের মতোই ‘ডেইলি টেন স্কুল’ চলছে।

যে কেউ এ উদ্যোগের স্বেচ্ছাসেবক হতে পারবেন। শুধু ২০০ টাকায় নিবন্ধন করে, মাসে ৩০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হবে। ০১৭১৩২২২৩৪৩, ০১৮৭৩৭০৮০০ নম্বরে ফোন করে স্বেচ্ছাসেবী হওয়ার তথ্য পাওয়া যাবে। www.vkhdb.org ওয়েবসাইটে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে। এছাড়া ফেসবুকের fb.com/vkhbd এই পেজে প্রতিদিনের খবর মিলবে।

আরও পড়ুন

×