দুর্ভোগের নাম বিআরটি

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০
দেশের ব্যস্ততম সড়কে যানজটের দুর্ভোগ নিরসনে নেওয়া বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পই এখন ভোগাচ্ছে। নিরাপত্তা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে চীনা ঠিকাদারদের বারবার তাগিদ দিয়ে লাভ হয়নি। এতে চরম দুর্ভোগ ও প্রাণহানি হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সরকারি সংস্থা শাস্তি দেয়নি টাকার সংকটে কাজ করতে না পারা ঠিকাদারদের। ফলে ২০১২ সালের এই প্রকল্পের ব্যয় আড়াই গুণ এবং সময় তিন দফা বাড়িয়েও কাজ শেষ হয়নি।
আগামী ডিসেম্বরেও চালু হবে না বিআরটি। অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে আগামী জুলাইয়ে বিআরটিসির বাস উল্টো পথে চালিয়ে যাত্রী পরিবহনের চিন্তা করা হচ্ছে। বিশেষায়িত ইলেকট্রিক বাস কেনার দরপত্র হয়নি। বাস কিনতে ঋণ দেবে ফ্রান্সের এজেন্সিস ফ্রান্সি ডি ডেভেলপমেন্ট (এএফডি)। তাদের শর্তের বেড়াজাল পেরিয়ে আগামী দুই বছরের আগে বাস পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যানজট নিরসনে ২০০৪ সালের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) ঢাকায় তিনটি বিআরটি ও তিনটি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা, টঙ্গী, উত্তরা, বিমানবন্দর, বনানী, মহাখালী, কাকরাইল, পল্টন, পুরান ঢাকা হয়ে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত ৪১ কিলোমিটার বিআরটি লাইন-৩ নির্মাণ প্রকল্প ২০১২ সালে অনুমোদন পায়। কিন্তু অর্থায়ন জটিলতায় প্রথম ধাপে জয়দেবপুর থেকে বিমানবন্দর সাড়ে ২০ কিলোমিটার বিআরটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। ২ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষের পরিকল্পনা ছিল।
বিআরটি পদ্ধতিতে সড়কের মাঝবরাবর বাসের জন্য পৃথক লেন থাকে। যেখানে সড়ক সরু, সেখানে বাসের লেন থাকে ফ্লাইওভারে। বিআরটি লেনে সিগন্যাল ছাড়াই ট্রেনের মতো বিনা বাধায় চলে বাস। অন্য কোনো যানবাহন বিআরটি লেনে চলতে পারে না।
জয়দেবপুর-বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার বিআরটি লেনের সাড়ে চার কিলোমিটার থাকবে ভায়াডাক্টের (উড়াল অংশ) ওপর। বাকি ১৭ কিলোমিটার রাস্তার ওপর। নির্মাণ করা হচ্ছে ১০ লেনের টঙ্গী সেতু। যাত্রী ওঠানামায় রাস্তায় থাকবে ২৫টি স্টেশন।
প্রকল্প অনুমোদনের পাঁচ বছর পর পূর্ণাঙ্গ নকশা ছাড়াই ২০১৭ সালে বিআরটির কাজই শুরু হয়। ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার
২৬৮ কোটি টাকা। তবে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়ে ব্যয় ৪ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা করে ডিপিপি দ্বিতীয়বারের মতো সংশোধনের কাজ চলছে। প্রতি কিলোমিটারে ২২১ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। ঢাকার বিআরটি পৃথিবীতে সবচেয়ে ব্যয়বহুল।
বিআরটি নির্মাণ ও পরিচালনায় স্বতন্ত্র ঢাকা বিআরটি লিমিটেড নামে সরকারি কোম্পানি গঠন করেছে সরকার। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেছেন, আগামী মার্চের মধ্যে বিআরটি অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হবে। জুলাইয়ে বাস চলবে।
বিআরটি লেনে চালানোর জন্য ১০৩টি বিশেষায়িত ইলেকট্রিক বাস কেনা হবে এএফডির ঋণে। মাহবুবুল বারী সমকালকে জানিয়েছেন, এক বছর বাসে স্পেসিফিকেশন তৈরি করে দিয়েছেন। বিআরটি লেনে বাস নিয়ন্ত্রণে কিনতে হবে ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম (আইটিএস)। বাস ও আইটিএস এখন প্রকল্পের মূল চ্যালেঞ্জ আন্তর্জাতিক দরপত্রে এগুলো কিনতে অনেক সময় লাগবে।
বিআরটি লেনে রাস্তার মাঝে স্টেশন থাকবে। ফলে যাত্রী ওঠানামায় বাসের ডান পাশে দরজা থাকতে হবে। বিশেষায়িত বাস না পাওয়া পর্যন্ত বিআরটি লেনে বিআরটিসির বাস উল্টো পথে চালানো হবে। ফলে বাসের দরজা স্টেশনমুখী হবে। যাত্রীরা ডান পাশ দিয়ে নামতে পারবেন।
ঢাকা বিআরটির এমডি সফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেছেন, বিআরটিসির বাস অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে চালানো হবে। এএফডির সঙ্গে আজ বুধবার বৈঠক হবে। প্রাথমিক ইওআই আহ্বান করা হয়েছে। দরপত্রও তৈরি করে রাখা হয়েছে। ঋণদাতার সম্মতি পেলে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, দরপত্রে অন্তত আট মাস লাগবে। যে প্রতিষ্ঠান কাজ পাবে, তারা কাস্টমাইজ বাস নির্মাণ করে দিতে আরও অন্তত দেড় বছর লাগবে। ফলে দুই বছরের আগে বাস আসার সম্ভাবনা নেই। দরপত্র আহ্বানে দেরি হলে বিলম্ব আরও বাড়বে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) প্রকল্পের বিভিন্ন অংশ বাস্তবায়ন করছে। উন্মুক্ত দরপত্রে চীনের জিয়াংশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৯ শতাংশ কমে উড়াল অংশের এবং চায়না গেঝুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড ২২ শতাংশ কমে মাটির ওপরের অংশের কাজ পায়।
গত সোমবার রাজধানীর উত্তরার জসীম উদ্দীন মোড়ে ক্রেন কাত হয়ে বিআরটির ভায়াডাক্টের (উড়াল অংশ) বক্সগার্ডার প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এ অংশের ঠিকাদার গেঝুবা। প্রকল্পের সওজ অংশের পরিচালক এ এস এম ইলিয়াস শাহ সমকালকে বলেছেন, শুরু থেকেই ঠিকাদারের টাকার সংকট রয়েছে। সে কারণে কাজ বিঘ্নিত হয়েছে। বারবার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। চীনা দূতাবাসকে জানানো হয়েছে; কিন্তু ঠিকাদার গা করেনি।
উড়াল অংশের ঠিকাদার জিয়াংশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশনও আর্থিক সংকটে কাজ করতে পারেনি। তাগাদা দিলেও চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে কাজ করতে না পারায় ঠিকাদারকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। নির্ধারিত সময়ে কাজ না করলে জরিমানা ও চুক্তি বাতিলের সুযোগ রয়েছে। কেন তা করা হয়নি- এ বিষয়ে বিবিএ অংশের প্রকল্প পরিচালক মহিরুল ইসলাম খানের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল।
ঠিকাদার নির্দিষ্ট অংশের কাজ করে বিল পায়। প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনা না করে ঠিকাদারদের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। আগাম টাকা দিয়েও লাভ হয়নি। অর্থ সংকট কাটাতে গত মার্চে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাছে ১৮৭ মিলিয়ন ডলার চায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
গত দেড় বছরে অন্তত চারটি দুর্ঘটনা ঘটেছে বিআরটি প্রকল্পে। গত ১৫ জুলাই গাজীপুরে গার্ডার নিরাপত্তাকর্মী নিহত হন। প্রকল্পের পরামর্শক স্ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের দলনেতা অধ্যাপক ড. মাহবুবুল বারী সমকালকে বলেছেন, গত মাসের দুর্ঘটনার পরই ঠিকাদারকে নিরাপত্তা বিষয়ে কী কী করণীয়, তা জানানো হয়। ঠিকাদার না মানলে পরামর্শক কী করতে পারে?
বিআরটির সমীক্ষা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত 'করিডোর' জয়দেবপুর-টঙ্গী সড়কে দিনে ৬০ হাজারের বেশি গাড়ি চলে। কিন্তু সমীক্ষায় প্রাক্কলন করা হয় ৩৫ হাজার গাড়ি। ব্যস্ততম এ সড়কটি বিআরটির নির্মাণকাজের কারণে জায়গায় জায়গায় খোঁড়া হয়। এতে রাস্তা সংকুচিত হয়ে তীব্র যানজট হয়। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার পথ যেতে ৮-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত লাগত। খোদ প্রধানমন্ত্রী এই দুর্ভোগ নিরসনের নির্দেশ দেন। সমাধানে সড়ক ও সেতু সচিব প্রকল্প এলাকায় গিয়ে বৈঠক করেন।
মাহবুবুল বারী সমকালকে বলেছেন, ঠিকাদাররা অনেক কম দর দিয়ে কাজ পেয়েছে। তারা কাজ করতে পারবে কিনা, তা কার্যাদেশ দেওয়ার আগে দেখা উচিত ছিল। তাদের সাধারণ প্রবণতা টাকা সাশ্রয় করা। ট্রাফিক ব্যবস্থা সচল রাখা, নির্মাণ এলাকার সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তায় খরচ করেনি। নিম্নমাণের নির্মাণসামগ্রী দিয়েছে। যদিও তা পরীক্ষায় ধরা পড়ায় নির্মাণসামগ্রী বদল করে দিয়েছে। ঠিকাদার মালামাল সরবরাহকারীদেরও ঠিকমতো বিল দেয়নি।
ঠিকাদারের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ থাকলেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? এ প্রশ্নে সওজ অংশের পিডি ইলিয়াস শাহ সমকালকে বলেছেন, জরিমানা করলে আইনি প্রশ্ন আসত। আর এখন ৮০ ভাগ কাজ হয়ে গেছে। এ পর্যায়ে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলে নতুন করে দরপত্র করে ঠিকাদার নিয়োগ দিতে হবে। এতে দীর্ঘ সময় লাগবে। প্রকল্প ঝুলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিমানবন্দর-জয়দেবপুর অংশ নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতা ও ভোগান্তির কারণ দেখিয়ে ঝিলমিল পর্যন্ত বিআরটির বাকি অংশ নির্মাণে আগ্রহী নয় সরকার। খোদ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একাধিকবার বলেছেন, ঢাকাকে দুর্ভোগ থেকে রক্ষায় বাকি অংশ হবে না। কিন্তু খি ত বিআরটি কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। গাজীপুর থেকে বিআরটিতে ঘণ্টায় আসা ১২ হাজার যাত্রী বাকি পথ কীভাবে যাবেন, তার সমাধান নেই।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেছেন, বাংলাদেশের পরে পরিকল্পনা করে ভারত, পাকিস্তান বিআরটি করে ফেলেছে। বিআরটি নির্মাণ সবচেয়ে সহজ। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো হয়েছে। এই প্রকল্পের কারণে গাজীপুর অচল হয়ে গেছে।
চারটি প্যাকেজে বিআরটির কাজ চলছে। বাসের জন্য ১৭ কিলোমিটার পৃথক লেনের কাজ জুন পর্যন্ত ৬৫ দশমিক ৮ ভাগ হয়েছে। ২ হাজার ৮১২ মিটার দীর্ঘ ছয়টি ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হয়েছে ৮৫ ভাগ। টঙ্গীতে ১৭৫ মিটার সেতুর কাজ হয়েছে ৭০ ভাগ। ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেছেন, প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮০ ভাগের বেশি।
আগামী ডিসেম্বরেও চালু হবে না বিআরটি। অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে আগামী জুলাইয়ে বিআরটিসির বাস উল্টো পথে চালিয়ে যাত্রী পরিবহনের চিন্তা করা হচ্ছে। বিশেষায়িত ইলেকট্রিক বাস কেনার দরপত্র হয়নি। বাস কিনতে ঋণ দেবে ফ্রান্সের এজেন্সিস ফ্রান্সি ডি ডেভেলপমেন্ট (এএফডি)। তাদের শর্তের বেড়াজাল পেরিয়ে আগামী দুই বছরের আগে বাস পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যানজট নিরসনে ২০০৪ সালের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) ঢাকায় তিনটি বিআরটি ও তিনটি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা, টঙ্গী, উত্তরা, বিমানবন্দর, বনানী, মহাখালী, কাকরাইল, পল্টন, পুরান ঢাকা হয়ে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত ৪১ কিলোমিটার বিআরটি লাইন-৩ নির্মাণ প্রকল্প ২০১২ সালে অনুমোদন পায়। কিন্তু অর্থায়ন জটিলতায় প্রথম ধাপে জয়দেবপুর থেকে বিমানবন্দর সাড়ে ২০ কিলোমিটার বিআরটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। ২ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষের পরিকল্পনা ছিল।
বিআরটি পদ্ধতিতে সড়কের মাঝবরাবর বাসের জন্য পৃথক লেন থাকে। যেখানে সড়ক সরু, সেখানে বাসের লেন থাকে ফ্লাইওভারে। বিআরটি লেনে সিগন্যাল ছাড়াই ট্রেনের মতো বিনা বাধায় চলে বাস। অন্য কোনো যানবাহন বিআরটি লেনে চলতে পারে না।
জয়দেবপুর-বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার বিআরটি লেনের সাড়ে চার কিলোমিটার থাকবে ভায়াডাক্টের (উড়াল অংশ) ওপর। বাকি ১৭ কিলোমিটার রাস্তার ওপর। নির্মাণ করা হচ্ছে ১০ লেনের টঙ্গী সেতু। যাত্রী ওঠানামায় রাস্তায় থাকবে ২৫টি স্টেশন।
প্রকল্প অনুমোদনের পাঁচ বছর পর পূর্ণাঙ্গ নকশা ছাড়াই ২০১৭ সালে বিআরটির কাজই শুরু হয়। ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার
২৬৮ কোটি টাকা। তবে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়ে ব্যয় ৪ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা করে ডিপিপি দ্বিতীয়বারের মতো সংশোধনের কাজ চলছে। প্রতি কিলোমিটারে ২২১ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। ঢাকার বিআরটি পৃথিবীতে সবচেয়ে ব্যয়বহুল।
বিআরটি নির্মাণ ও পরিচালনায় স্বতন্ত্র ঢাকা বিআরটি লিমিটেড নামে সরকারি কোম্পানি গঠন করেছে সরকার। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেছেন, আগামী মার্চের মধ্যে বিআরটি অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হবে। জুলাইয়ে বাস চলবে।
বিআরটি লেনে চালানোর জন্য ১০৩টি বিশেষায়িত ইলেকট্রিক বাস কেনা হবে এএফডির ঋণে। মাহবুবুল বারী সমকালকে জানিয়েছেন, এক বছর বাসে স্পেসিফিকেশন তৈরি করে দিয়েছেন। বিআরটি লেনে বাস নিয়ন্ত্রণে কিনতে হবে ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম (আইটিএস)। বাস ও আইটিএস এখন প্রকল্পের মূল চ্যালেঞ্জ আন্তর্জাতিক দরপত্রে এগুলো কিনতে অনেক সময় লাগবে।
বিআরটি লেনে রাস্তার মাঝে স্টেশন থাকবে। ফলে যাত্রী ওঠানামায় বাসের ডান পাশে দরজা থাকতে হবে। বিশেষায়িত বাস না পাওয়া পর্যন্ত বিআরটি লেনে বিআরটিসির বাস উল্টো পথে চালানো হবে। ফলে বাসের দরজা স্টেশনমুখী হবে। যাত্রীরা ডান পাশ দিয়ে নামতে পারবেন।
ঢাকা বিআরটির এমডি সফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেছেন, বিআরটিসির বাস অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে চালানো হবে। এএফডির সঙ্গে আজ বুধবার বৈঠক হবে। প্রাথমিক ইওআই আহ্বান করা হয়েছে। দরপত্রও তৈরি করে রাখা হয়েছে। ঋণদাতার সম্মতি পেলে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, দরপত্রে অন্তত আট মাস লাগবে। যে প্রতিষ্ঠান কাজ পাবে, তারা কাস্টমাইজ বাস নির্মাণ করে দিতে আরও অন্তত দেড় বছর লাগবে। ফলে দুই বছরের আগে বাস আসার সম্ভাবনা নেই। দরপত্র আহ্বানে দেরি হলে বিলম্ব আরও বাড়বে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) প্রকল্পের বিভিন্ন অংশ বাস্তবায়ন করছে। উন্মুক্ত দরপত্রে চীনের জিয়াংশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৯ শতাংশ কমে উড়াল অংশের এবং চায়না গেঝুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড ২২ শতাংশ কমে মাটির ওপরের অংশের কাজ পায়।
গত সোমবার রাজধানীর উত্তরার জসীম উদ্দীন মোড়ে ক্রেন কাত হয়ে বিআরটির ভায়াডাক্টের (উড়াল অংশ) বক্সগার্ডার প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এ অংশের ঠিকাদার গেঝুবা। প্রকল্পের সওজ অংশের পরিচালক এ এস এম ইলিয়াস শাহ সমকালকে বলেছেন, শুরু থেকেই ঠিকাদারের টাকার সংকট রয়েছে। সে কারণে কাজ বিঘ্নিত হয়েছে। বারবার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। চীনা দূতাবাসকে জানানো হয়েছে; কিন্তু ঠিকাদার গা করেনি।
উড়াল অংশের ঠিকাদার জিয়াংশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশনও আর্থিক সংকটে কাজ করতে পারেনি। তাগাদা দিলেও চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে কাজ করতে না পারায় ঠিকাদারকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। নির্ধারিত সময়ে কাজ না করলে জরিমানা ও চুক্তি বাতিলের সুযোগ রয়েছে। কেন তা করা হয়নি- এ বিষয়ে বিবিএ অংশের প্রকল্প পরিচালক মহিরুল ইসলাম খানের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল।
ঠিকাদার নির্দিষ্ট অংশের কাজ করে বিল পায়। প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনা না করে ঠিকাদারদের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। আগাম টাকা দিয়েও লাভ হয়নি। অর্থ সংকট কাটাতে গত মার্চে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাছে ১৮৭ মিলিয়ন ডলার চায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
গত দেড় বছরে অন্তত চারটি দুর্ঘটনা ঘটেছে বিআরটি প্রকল্পে। গত ১৫ জুলাই গাজীপুরে গার্ডার নিরাপত্তাকর্মী নিহত হন। প্রকল্পের পরামর্শক স্ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের দলনেতা অধ্যাপক ড. মাহবুবুল বারী সমকালকে বলেছেন, গত মাসের দুর্ঘটনার পরই ঠিকাদারকে নিরাপত্তা বিষয়ে কী কী করণীয়, তা জানানো হয়। ঠিকাদার না মানলে পরামর্শক কী করতে পারে?
বিআরটির সমীক্ষা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত 'করিডোর' জয়দেবপুর-টঙ্গী সড়কে দিনে ৬০ হাজারের বেশি গাড়ি চলে। কিন্তু সমীক্ষায় প্রাক্কলন করা হয় ৩৫ হাজার গাড়ি। ব্যস্ততম এ সড়কটি বিআরটির নির্মাণকাজের কারণে জায়গায় জায়গায় খোঁড়া হয়। এতে রাস্তা সংকুচিত হয়ে তীব্র যানজট হয়। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার পথ যেতে ৮-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত লাগত। খোদ প্রধানমন্ত্রী এই দুর্ভোগ নিরসনের নির্দেশ দেন। সমাধানে সড়ক ও সেতু সচিব প্রকল্প এলাকায় গিয়ে বৈঠক করেন।
মাহবুবুল বারী সমকালকে বলেছেন, ঠিকাদাররা অনেক কম দর দিয়ে কাজ পেয়েছে। তারা কাজ করতে পারবে কিনা, তা কার্যাদেশ দেওয়ার আগে দেখা উচিত ছিল। তাদের সাধারণ প্রবণতা টাকা সাশ্রয় করা। ট্রাফিক ব্যবস্থা সচল রাখা, নির্মাণ এলাকার সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তায় খরচ করেনি। নিম্নমাণের নির্মাণসামগ্রী দিয়েছে। যদিও তা পরীক্ষায় ধরা পড়ায় নির্মাণসামগ্রী বদল করে দিয়েছে। ঠিকাদার মালামাল সরবরাহকারীদেরও ঠিকমতো বিল দেয়নি।
ঠিকাদারের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ থাকলেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? এ প্রশ্নে সওজ অংশের পিডি ইলিয়াস শাহ সমকালকে বলেছেন, জরিমানা করলে আইনি প্রশ্ন আসত। আর এখন ৮০ ভাগ কাজ হয়ে গেছে। এ পর্যায়ে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলে নতুন করে দরপত্র করে ঠিকাদার নিয়োগ দিতে হবে। এতে দীর্ঘ সময় লাগবে। প্রকল্প ঝুলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিমানবন্দর-জয়দেবপুর অংশ নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতা ও ভোগান্তির কারণ দেখিয়ে ঝিলমিল পর্যন্ত বিআরটির বাকি অংশ নির্মাণে আগ্রহী নয় সরকার। খোদ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একাধিকবার বলেছেন, ঢাকাকে দুর্ভোগ থেকে রক্ষায় বাকি অংশ হবে না। কিন্তু খি ত বিআরটি কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। গাজীপুর থেকে বিআরটিতে ঘণ্টায় আসা ১২ হাজার যাত্রী বাকি পথ কীভাবে যাবেন, তার সমাধান নেই।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেছেন, বাংলাদেশের পরে পরিকল্পনা করে ভারত, পাকিস্তান বিআরটি করে ফেলেছে। বিআরটি নির্মাণ সবচেয়ে সহজ। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো হয়েছে। এই প্রকল্পের কারণে গাজীপুর অচল হয়ে গেছে।
চারটি প্যাকেজে বিআরটির কাজ চলছে। বাসের জন্য ১৭ কিলোমিটার পৃথক লেনের কাজ জুন পর্যন্ত ৬৫ দশমিক ৮ ভাগ হয়েছে। ২ হাজার ৮১২ মিটার দীর্ঘ ছয়টি ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হয়েছে ৮৫ ভাগ। টঙ্গীতে ১৭৫ মিটার সেতুর কাজ হয়েছে ৭০ ভাগ। ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেছেন, প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮০ ভাগের বেশি।
- বিষয় :
- বাস র্যাপিড ট্রানজিট
- দুর্ভোগ
- বিআরটি