‘অন্য শিল্পের তুলনায় চা শ্রমিকদের সুবিধা বেশি’

রাজধানীর গুলশানে চা বাগান মালিকদের সমিতির সংবাদ সম্মেলন।
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২২ | ০৬:১৭ | আপডেট: ৩০ আগস্ট ২০২২ | ০৬:৪২
অন্যান্য শিল্পের চেয়ে চা শিল্পের শ্রমিকরা বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে বলে দাবি করেছে চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদ। কোন খাতে কত দেওয়া হয় তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে সংগঠনের পক্ষ থেকে।
হাজিরাভিত্তিক দৈনিক ১৭০ টাকার যে মজুরি দেওয়া হচ্ছে সেটাও সর্বনিম্ন। প্রকৃতপক্ষে গড় মজুরি আরও অনেক বেশি। দেশের শ্রম আইন এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিবিড় তদারকির মধ্যে শ্রমঅধিকার ভোগ করছে শ্রমিকরা।
মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি এবং দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। সম্প্রতি শ্রমিকদের ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে দেশে এবং দেশের বাইরে চা শিল্প নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। কম মজুরি দিয়ে শ্রমিকদের প্রতি মালিকরা অমানবিক কাজ করছে- এর প্রতিবাদে অনেকে চা বর্জন করেছে। এসবের পেছনে অপপ্রচারেরও কিছুটা দায়ী বলে মনে করেন সংগঠনের নেতারা।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বর্তমান মজুরির ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী চা শ্রমিকদের দৈনিক ন্যূনতম নগদ মজুরি ১২০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা করা হয়েছে। বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন প্রধানমন্ত্রীর নির্ধারিত মজুরি মেনে নিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে নগদ ও অনগদ দৈনিক পারিশ্রমিকসহ মোট মজুরি ৫০০ টাকার ওপরে গিয়ে দাঁড়ায়।
বিশেষভাবে আমরা উল্লেখ করতে চাই, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা যিনি করোনা মহামারিকালে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। চা শিল্প চালু রেখে এই শিল্পের সক্ষমতা ও শ্রমিকদের আয় এবং চাকরির নিরাপত্তা বিধান করেন। চা বাগান এলাকায় করোনাকালে করোনায় আক্রান্ত রোগী ছিল না বললেই চলে এবং প্রায় শতভাগ শ্রমিক করোনা টিকা কর্মসূচির আওতায় এসেছেন।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিবিএর সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী ১৯৪৮ সাল থেকে চা শিল্পের উদ্যোক্তারা বাগানের সব শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য রেশনের মাধ্যমে খাদ্যসহায়তা দিয়ে আসছেন। প্রতি সপ্তাহে একজন শ্রমিককে ন্যূনতম ৮ কেজি করে রেশন (চাল বা আটা) দেওয়া হয়। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বিবেচনায় সেটা সপ্তাহে ১৩ কেজি পর্যন্ত হয়।
একজন শ্রমিক নামমাত্র মূল্যে প্রতি কেজি ২ টাকা হিসেবে চাল বা আটা ক্রয় করেন। সে হিসেবে প্রতি মাসে একজন শ্রমিক পরিবার গড়ে ৪২ কেজি পর্যন্ত রেশন পেয়ে থাকেন। শ্রমিকের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাগানের মোট আয়তনের প্রায় ১৫ শতাংশ অর্থাৎ ৯৪ হাজার বিঘা জমি চাষাবাদের জন্য চা শ্রমিকেরা ব্যবহার করে আসছেন। দেখা গেছে, একটি বাগানের প্রায় ৬০ শতাংশ শ্রমিকই এই সুবিধা ভোগ করছেন।
বাসস্থানের প্রসঙ্গে বলা যায়, বাংলাদেশের চা শিল্পে আনুমানিক ৭০,০০০ পাকা ও সেমিপাকা কোম্পানি প্রদত্ত ঘরে প্রায় লাখের ওপর শ্রমিক পরিবারসহ বসবাস করেন। এছাড়াও চা বাগানের জমিতে শ্রমিক পরিবারের বর্ধিত সদস্যরা নিজস্ব ব্যয়ে নির্মিত ঘর বাড়িতে বসবাস করে থাকেন।
চা শ্রমিক ও তার পুরো পরিবারের সকলেই বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন অথচ অন্যান্য শিল্পে শুধু শ্রমিক নিজেই এই সুবিধা পান। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, শ্রমিকদের মৃত্যুর পরেও তার পরিবারের জন্য এই সুবিধা বহাল থাকে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চা শিল্পে ২টি বড় আকারের আধুনিক গ্রুপ হাসপাতাল এবং ৮৪টি গার্ডেন হাসপাতালে ৭২১ শয্যার ব্যবস্থা, ১৫৫ টি ডিসপেনসারিসহ মোট ৮৯০ জনের অধিক মেডিকেল স্টাফ নিয়োজিত আছেন।
১৬৮ বছরের পুরোনো শিল্প হিসেবে চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যান্য যেকোনো শিল্পের তুলনায় অনেক আগে থেকেই শ্রম আইন অনুসরণপূর্বক নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সম-মজুরি নিশ্চিত করেছে।
চা শিল্পে ১৯৩৯ সাল থেকে নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ও আইন নির্ধারিত মাতৃকালীন ভাতা দিয়ে থাকেন। চা বাগানগুলো গর্ভ ও প্রসবকালীন জটিলতাসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করছে যা বাংলাদেশে প্রচলিত অন্য যেকোনো শিল্পে বিরল। সর্বোপরি সবদিক থেকেই চা শিল্প অনেক আগে থেকে সুসংগঠিত একটি শিল্প।
বাংলাদেশের চায়ের ফলন অত্যন্ত সন্তোষজনক। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে উৎপাদিত চায়ের বার্ষিক মূল্যমান প্রায় ৩৫০০ কোটি টাকা। হিসেবে প্রতি কেজি চা উৎপাদন খরচ যেখানে ২০২ টাকার মতো, সেখানে প্রতি কেজি চায়ের নিলামমূল্য ২০০ টাকা মাত্র। বিগত দশ বছরে শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে সর্বাধিক ৭৩.৯১ শতাংশ এবং গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। এমতাবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে কর্মবিরতির মতো সিদ্ধান্ত চা শিল্পের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে পড়েছে।
চা শিল্প আমাদের সবার। দেশের সরকার, চা বাগান মালিক, চা শ্রমিক ও আপামর জনসাধারণসহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই শিল্পে উত্তোরত্তর টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। চা শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই দেশে গত বছর চায়ের রেকর্ড ফলন হয়েছে; যার পরিমাণ ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজিরও বেশি। বিশ্বে চা উৎপাদনে দশম স্থানে বাংলাদেশ। এ শিল্পকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
প্রকৃত তথ্য জানিয়ে নেতিবাচক এই ভাবমূর্তি কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা হিসেবে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। রাজধানীর গুলশানে পুলিশ প্লাজার এম আনিস উদ দৌলা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন সংগঠনের সভাপতি এম শাহ আলম। চা সংসদের অন্য নেতারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।