ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ফ্লাইওভারে সুড়ঙ্গ অভিযান

ফ্লাইওভারে সুড়ঙ্গ অভিযান

ছিনতাইকারী ধরতে বৃহস্পতিবার মগবাজার ফ্লাইওভারে ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতায় অভিযান চালায় পুলিশ- সংগৃহীত

আব্দুল হামিদ

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১১ আগস্ট ২০২৩ | ০৭:৪০

রাত তখন সাড়ে ১১টা। আরামবাগের একটি প্রেসের কর্মচারী শামীম আহমেদ মিরপুরের বাসার উদ্দেশে ফিরছিলেন। রাজধানীর মগবাজারের কাছে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের পাশ থেকে ফ্লাইওভারে ওঠার পর তাঁর মোটরসাইকেল নষ্ট হয়ে যায়। উপায়ান্তর না দেখে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে ঠেলে মোটরসাইকেল নিয়ে যাচ্ছিলেন। মধ্যরাতে মোটরসাইকেল নিয়ে বিপাকে পড়া শামীমকে সতর্ক হয়ে মোটরসাইকেল ঠেলার পরামর্শ দেয় অচেনা দুই নারী। তারা বলে, রেলিং ঘেঁষে না চললে শামীম দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন।

কথায় কথায় শামীমের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠার চেষ্টা করে তারা। এর পরই এক ধরনের সাংকেতিক শব্দ করে দুই নারী। ওই শব্দ পেয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ৩-৪ জন চাপাতিসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শামীমকে ঘিরে ধরে। ফ্লাইওভারের ওপরেই তাঁকে কুপিয়ে আহত করে মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। শামীম দেখতে পান, তাঁর চোখের সামনেই ছিনতাইকারী চক্রের সবাই ফ্লাইওভারের একটি ‘সুড়ঙ্গে’ লুকাচ্ছে। এ ঘটনা বুধবারের।

শামীমের কাছ থেকে এ অভিযোগ পাওয়ার পর নড়েচড়ে বসে পুলিশ। ফ্লাইওভারের সুড়ঙ্গকেন্দ্রিক অভিনব অপরাধী চক্রের তথ্য জানতে পারে তারা। পিলারের ওপরে এবং ফ্লাইওভারের নিচে সুড়ঙ্গের মতো সেই ফাঁকা জায়গা ছিনতাইকারীরা গোপন আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল। অভিনব এ দৃশ্য দেখে বিস্মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও।

শামীমের ওই ঘটনার পর সুড়ঙ্গকেন্দ্রিক ছিনতাইকারী চক্রের চার সদস্যকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দু’জন নারীও রয়েছে। সুড়ঙ্গ থেকে ছিনতাই চক্রের সদস্যকে ধরতে গতকাল বৃহস্পতিবার ফায়ার সার্ভিসের সহায়তা নেয় পুলিশ। সিজার লিফট ভেহিক্যালের মাধ্যমে নিচ থেকে সুড়ঙ্গ পর্যন্ত পৌঁছান ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। সেখান থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।  

এ চক্রের প্রধান আকবর হোসেন। তার সহযোগী রবিউল হোসেন হৃদয়। তবে এ চক্রে আছে কয়েক নারী ছিনতাইকারী। তারা দিনের বেশির ভাগ সময় থাকত সুড়ঙ্গের ভেতর। রাতে সুযোগ বুঝে নারী সহযোগীরা পথচারীকে কথার ফাঁদে ফেলে আটকে রাখত। পথচারীর কাছে মূল্যবান কিছু আছে বুঝতে পারলেই এক ধরনের সাংকেতিক শব্দ করলে সুড়ঙ্গ থেকে দেশি অস্ত্র নিয়ে পথচারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত সহযোগীরা। পরে ছিনতাই করে নারী সদস্যদের নিয়ে নিরাপদে সুড়ঙ্গে উঠে যেত আকবর। সুড়ঙ্গের ভেতর তারা অনৈতিক কাজেও লিপ্ত ছিল।

মগবাজার ফ্লাইওভার দিয়ে রাতে হেঁটে ও মোটরসাইকেলে চলাচলকারী পথচারীদের টার্গেট করত ছিনতাইকারী চক্রের নারী সদস্যরা। তারা পথচারীদের প্রথমে অনৈতিক কাজের প্রস্তাব দিত। কেউ রাজি হলে রশি ও কাঠের মই দিয়ে সুড়ঙ্গের মধ্যে নিয়ে যেত। তারপর তার সবকিছু কেড়ে নিত। কেউ যেতে রাজি না হলে সাংকেতিক শব্দ (শিস) করে সহযোগীদের ডাকত। পরে আকবরসহ তার সহযোগীরা ১০ সেকেন্ডের মধ্যে সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত।

পুলিশ বলছে, দিনের পর দিন হাজার হাজার মানুষ মগবাজার ফ্লাইওভার ব্যবহার করলেও কেউ জানতে পারেনি এই সুড়ঙ্গের কথা। ফ্লাইওভারের মধ্যে অপরাধীদের বিচরণ ক্ষেত্র থাকার কথা ছিল সবার কল্পনার বাইরে। সেখানে ছিনতাইকারীরা টানা সাত দিনও অবস্থান করেছে। তাদের নারী সহযোগীরা খাবারসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করত।

চক্রের মূল হোতা আকবর হোসেন, সহযোগী রবিউল হোসেন হৃদয় ও নারী সহযোগী শেফালী ও মিম। তাদের কাছ থেকে চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে মূল হোতা আকবর পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ওপর থেকে লাফ দিলে রাস্তার ওপরে পড়ে আহত হয়। বর্তমানে সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পুলিশ পাহারায় চিকিৎসাধীন।

হাতিরঝিল থানার ওসি শাহ মো. আওলাদ হোসেন সমকালকে বলেন, ফ্লাইওভারের নিচে পিলারের ওপরে গোপন আস্তানায় তারা ছোট একটি মই, পুরোনো কম্বল ও রশি ব্যবহার করে সুড়ঙ্গে ওঠানামা করত। তারা লোকচক্ষুর আড়ালে সেখানে দীর্ঘদিন থেকে ওঠানামা করে আসছে।

ওসি বলেন, তারা ফ্লাইওভারের নিচে পিলারের ওপরে অভিযান চালাতে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তা চান। পরে তেজগাঁও ফায়ার স্টেশন থেকে একটি টিম এসে পিলারের ওপরে ওঠার জন্য বড় মই ও গাড়ি দিয়ে সহযোগিতা করে। গ্রেপ্তারদের নামে ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে। আজ তাদের আদালতে তোলা হবে। এ ছাড়া এই চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। তাদের সঙ্গে আর কারা আছে, তাদের খোঁজ করা হচ্ছে।

জানা গেছে, বুধবার রাতে ওই ছিনতাই চক্রের সদস্য মিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে সুড়ঙ্গে অভিযান চালিয়ে বাকিদের গ্রেপ্তার করে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। ওসি আওলাদ হোসেন বলেন, মগবাজার ফ্লাইওভারের পুরোটা হাতিরঝিল থানার মধ্যে না। কয়েকটি থানার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সেসব থানায় বার্তা পাঠানো হয়েছে। যে থানার মধ্যে সুড়ঙ্গ, সেই থানা ব্যবস্থা নেবে।

ছিনতাই চক্রের দলনেতা চিকিৎসাধীন আকবর জানায়, ওই সুড়ঙ্গে বসে মাদক সেবন করে এবং ছিনতাই করে সেখানে লুকিয়ে থাকত। তার সঙ্গে গতকালও তিন নারী ছিল– নাসরিন, রানী ও শেফালী। এদের মধ্যে নাসরিন ও রানী পুলিশ আসার আগেই সেখান থেকে পালিয়ে যায়। চক্রের কেউ কেউ যৌনকর্মী হিসেবেও কাজ করে।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের সহকারী কমিশনার এসএম আরিফ রায়হান বলেন, চক্রটি নারী ও পুরুষ দুই ভাগে কাজ করত। পুরুষ গ্রুপ অস্ত্র নিয়ে সুড়ঙ্গের মধ্যে অবস্থান করত; নারী গ্রুপ অনৈতিক কাজের জন্য ডেকে আনত।

আরও পড়ুন

×