ভবন-রেস্টুরেন্ট মালিকের দোষ কর্মচারীর ওপর

ছবি: সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৪ | ০৬:৪৫ | আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২৪ | ০৯:১০
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের পপাইস কফি অ্যান্ড ফাস্টফুডে আট কর্মচারী কাজ করেন নিয়মিত। যা বেতন পান তাতে সংসার খরচের পর কিছুই থাকে না। রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে গ্রেপ্তার আতঙ্কে তিন দিন ধরে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ। দোকানটি বেশি দিন বন্ধ থাকলে বেকার হয়ে যেতে পারেন– এমন আশঙ্কা তাদের।
রাজধানীর প্রায় প্রতিটি রেস্তোরাঁর কর্মচারীদের মধ্যেই এ ভীতি ভর করেছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের অভিযোগে গ্রেপ্তারও হতে হচ্ছে কর্মচারীদের। তাদের ভাষ্য, রাজধানীর প্রায় সব রেস্তোরাঁ ভবন মালিকের কাছ থেকে ফ্লোর ভাড়া নিয়ে গড়ে উঠেছে। সে পটভূমিতে নিয়ম-অনিয়মের জন্য দায়ী হওয়ার কথা ভবন মালিক ও রেস্তোরাঁ মালিকদের। তবে হয়রানির মুখে পড়ছেন কর্মচারীরা। পুলিশ কর্মচারীদেরই ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
বছরের পর বছর রাজধানীর রেস্তোরাঁর বিষয়ে নজরদারি ছিল না সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের প্রাণ হারানোর পর যেন চেতনা ফিরেছে তাদের। নড়েচড়ে বসে সেবা সংস্থাগুলো। বেইলি রোডের ওই ট্র্যাজেডির পর ৩ মার্চ থেকে রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে পুলিশ, রাজউক ও সিটি করপোরেশন। প্রশ্ন উঠেছে, এতদিন ছিল কোথায় সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্তরা? গ্রিন কোজি কটেজে যখন আটটি রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছিল, তখন কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? এতে কি দায়িত্বপ্রাপ্তদের কোনো দায় নেই? আর দুর্ঘটনার পর ঢালাওভাবে রেস্তোরাঁয় অভিযান চালানো হচ্ছে। হয়রানি করা হচ্ছে নিরীহ কর্মচারীদের। বুধবার দুপুর পর্যন্ত তিন দিনে রাজধানীতে ১ হাজার ১৩২ রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার রাখায় ২০৭ দোকানে এবং আটটি রাসায়নিক গুদামে অভিযান চালায় পুলিশ। তিন দিনে ৮৭২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধে আদালতে প্রসিকিউশন দেওয়া হয়। প্রসিকিউশন সংখ্যা ৮৮৭টি। প্রসিকিউশনে অভিযুক্তরা আদালতে অর্থদণ্ড দিয়ে ছাড়া পান। অবশ্য ২০ মামলা হয়েছে এই তিন দিনে।
এর মধ্যে মঙ্গলবার ৪০২ রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২২৮ জনকে। আর আদালতে প্রসিকিউশন দেওয়া হয়েছে ১৯২টি। মামলা হয়েছে ১০টি। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার রাখার অভিযোগে ১০৩ দোকান ও পাঁচটি রাসায়নিক গুদামে অভিযান চালানো হয়। এ ছাড়া রাজউক ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ২৩ প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে ৯ লাখ ৬৭ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। বিকেলে মেরাদিয়া ভূঁইয়াপাড়ার লাল মিয়ার হোটেলের সামনে রাস্তার ওপর গ্যাসের চুলা লাগিয়ে রান্না চলছিল। এ সময় খিলগাঁও পুলিশ হোটেলের ব্যবস্থাপক আশরাফুলকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে আদালতে প্রসিকিউশন দেওয়ার কথা রয়েছে।
খিলগাঁওয়ের ২৫/বি ভবনে অভিযান চালিয়ে কেএফসি, ডোমিনোজ পিৎজা, সিক্রেট রেসিপিসহ চার প্রতিষ্ঠানকে ৭ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালত। যখন ওই ভবনে অভিযান চালানো হয়, তখন আল কায়েদা পার্টি সেন্টার ও ক্রিমসন কাপ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ পাওয়া যায়।
রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কামরুল ইসলাম বলেন, কেএফসি ও ডোমিনোজ পিৎজায় ফায়ার সেফটি ও বিকল্প সিঁড়ি পাওয়া যায়নি। আবাসিক ভবনে এই রেস্তোরাঁ করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। অনিয়মের জন্য দুটি প্রতিষ্ঠানকে ২ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া সিক্রেট রেসিপিকে ২ লাখ ও চায়না ল্যান্ড রেস্টুরেন্টকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। তিনি বলেন, তাদের সব নিয়মকানুন মেনে প্রতিষ্ঠান চালাতে বলা হয়েছে। রেস্তোরাঁ মালিকের পাশাপাশি ভবন মালিককেও আইনের আওতায় আনা হবে।
আতঙ্কে কর্মচারীরা
চলমান অভিযানে রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা আতঙ্কে রয়েছেন। ৮২/এ আউটার সার্কুলার রোড মগবাজারের উজ্জল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক শফিউল্লাহ বলেন, ‘রেস্তোরাঁ না চললে আমাদের পেট চলবে না। তাই আতঙ্কের মধ্যেই খোলা রেখেছি। এই রেস্তোরাঁর কর্মী আবুল কালাম বলেন, বাড়িতে মা-বাবা, স্ত্রীসহ দুই সন্তান আছে। পরিবারে উপার্জনক্ষম বলতে একমাত্র আমি। এখন যদি কাজ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে পরিবার নিয়ে চলা কষ্টকর হবে।’
মগবাজারের ভাই ভাই বিরিয়ানি হাউসের কর্মী সোহেল জানান, প্রতিদিন ২০০ টাকা চুক্তিতে কাজ করেন তিনি। কাজ করলে বেতন, না করলে নেই। কোন সময় কী ঘটে এই আতঙ্কে আছি।
ঘরোনা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক হাসেম সিকদার জানান, গতকালও রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসেছিল। পুলিশ আসে প্রতিদিন সন্ধ্যায়, আতঙ্কে আছি। নিয়ম অনিয়মের জন্য দায়ী ভবন আর প্রতিষ্ঠানের মালিক। অথচ কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
খিলগাঁওয়ের পপাইস কফি অ্যান্ড ফাস্টফুডের ব্যবস্থাপক জানে আলম মৃধা জানান, গত সোমবার রাজউকের একটি দল ওই প্রতিষ্ঠানে যায়। ভবনটি বাণিজ্যিক অনুমোদন না থাকায় রেস্তোরাঁটি বন্ধ রাখতে বলা হয়। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসুরক্ষা ব্যবস্থা আছে। পেছনে জরুরি বহির্গমনের ব্যবস্থা রয়েছে। এর পরও বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। কর্মচারীদের বসিয়ে বেতন দিচ্ছেন মালিক। সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন। এভাবে বন্ধ থাকলে কতদিন তিনি বেতন দিতে পারবেন।
ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির অভিযান
গতকাল দুপুরে নিউ সুপার দক্ষিণ মার্কেটে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। অভিযানে নেতৃত্ব দেন ডিএসসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর আলম। সিঁড়িতে ভাসমান দোকান করার কারণে ১৩ দোকানকে ৫ হাজার টাকা করে মোট ৬৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, আমরা এখানে দেখেছি, সব সিঁড়ি দখল করে দোকান বসানো হয়েছে। কোনো দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ভেতরে পৌঁছাতে কিংবা মানুষজন বের হতে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করবে। বিকেলে ধানমন্ডি এলাকার ফুটপাতের তিনটি দোকানে ১২ হাজার টাকা জরিমানা করে ডিএসসিসি।
এদিকে অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকায় গুলশান-২-এর একটি ছয়তলা ও আরেকটি সাততলা বাণিজ্যিক ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ব্যানার টানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ভ্রাম্যমাণ আদালত। গতকাল দুপুরে ডিএনসিসির অঞ্চল-৩-এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জুলকার নায়ন এ আদালত পরিচালনা করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হাসান ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
এর আগে দুপুর ১২টায় গুলশান-২-এর ৪৬ নম্বর রোডের ৩৩ নম্বর হোল্ডিংয়ের এই ভবনে থাকা কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একই অভিযোগে ধানসিঁড়ি রেস্তোরাঁকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। আর ৩৪ নম্বর হোল্ডিংয়ে সেভা হাউসের সামনে সিঁড়িতে সরঞ্জাম রাখায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। দুটি ভবনেই অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যানার টানানো হয়েছে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জুলকার নায়ন বলেন, ৩৩ নম্বর হোল্ডিংয়ের বাণিজ্যিক ভবনটিতে অনেকগুলো রেস্তোরাঁ রয়েছে। কোনোটিতেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া এ ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয়তলায় ‘দি এইচ’ নামে একটি আবাসিক হোটেল রয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার রাতে ডিএনসিসি উত্তরা, মিরপুর ও গুলশান এলাকায় আট রেস্তোরাঁয় ১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা জরিমানা করে। এ ছাড়া অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় দুটি প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করা হয়।
- বিষয় :
- রেস্তোরাঁ