ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

বছরের পর বছর ওদের হাতেই চাঁদার নাটাই

সরেজমিন: গুলিস্তান

বছরের পর বছর ওদের হাতেই চাঁদার নাটাই

ছবি- সমকাল

বকুল আহমেদ

প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২৪ | ০১:০৫ | আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৪ | ০৮:৫২

‘ভাই, আমাদের নিয়ে পত্রিকায় লিখে লাভটা কী! ফুটপাত দখলমুক্ত কখনও হবে না। কারণ বন্ধ করার দায়িত্বে যারা, তারা খাচ্ছে লাভের গুড়। আমাদের চাঁদার টাকায় চলে অনেকে। এ টাকা নিচ থেকে উঁচুতে পোঁছায়। রমজানে এমনিতেই চাঁদার অঙ্ক বেড়ে গেছে। পত্রিকায় লেখালেখি করলে আরও বাড়বে।’– এভাবেই বলছিলেন রাজধানীর গুলিস্তানের খদ্দর বাজার শপিং কমপ্লেক্সের সামনের ফুটপাতের এক দোকানি। নাম পত্রিকায় ছাপা হলে ‘আম-ছালা’ সবই যাবে। তাই নাম লুকিয়েই বললেন মনের সব কথা। তুলে ধরেন কারা কখন, কীভাবে চাঁদা নেয় এর আদ্যোপান্ত।

গত দু’দিন গুলিস্তান ও আশপাশের ফুটপাতের অন্তত ৩০ দোকানির সঙ্গে কথা বলে সমকাল। তাদের ভাষ্য অভিন্ন। বছরের পর বছর ফুটপাতে ব্যবসা করছেন চাঁদা দিয়েই। তবে তারা লাইনম্যানদের হাতে চাঁদা না দিয়ে বৈধভাবে ব্যবসার অনুমতি সাপেক্ষে সিটি করপোরেশনকে টাকা দিতে চান। এতে চাঁদাবাজদের পকেটে চাঁদা না গিয়ে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পাবে।

দোকানিরা বৈধ উপায়ে দোকান বসানোর দাবি তুললেও রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা হিসেবে গুলিস্তানের ফুটপাত দখলমুক্ত থাকা জরুরি। ঢাকার নিম্ন আদালত, সদরঘাট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরান ঢাকা যাতায়াতের অন্যতম এলাকা গুলিস্তান। ঢাকায় প্রবেশের অন্যতম পথও এটি। এ ছাড়া পাশে আছে সচিবালয়। এসব কারণে গুলিস্তানে মানুষের চলাচল বেশি। তবে ফুটপাতে হাঁটার সুযোগ না পেয়ে মানুষকে হাঁটতে হয় রাস্তা দিয়ে। এতে বিভিন্ন যানবাহন নির্দিষ্ট গতিতে চলতে বাধা পায়। ফলে তীব্র হয় যানজট।

সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, বায়তুল মোকাররম মার্কেটের সামনে, স্টেডিয়ামের সামনে, জিরো পয়েন্টসহ গুলিস্তান এলাকায় ফুটপাত দখল করে অন্তত পাঁচ হাজার ব্যবসায়ী দোকান পেতেছেন। দোকান ও জায়গাভেদে এসব দোকানের প্রতিদিন চাঁদা ১৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। সেই হিসাবে প্রতি দোকানে গড়ে ২৫০ টাকা হলে দিনে মোট চাঁদা ওঠে সাড়ে ১২ লাখ টাকা। মাসে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। সরকারি জায়গা ‘ভাড়া’ দিয়ে অবৈধ দখলদারদের পকেটে চলে যাচ্ছে এ টাকা। এলাকাভিত্তিক স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির এসব ফুটপাত নিয়ন্ত্রণে সরাসরি ভূমিকা রয়েছে। ফুটপাতের চাঁদার টাকা সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশের পকেটেও যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে থানা বা ফাঁড়ির টহল পুলিশ সরাসরিও দোকানির কাছ থেকে টাকা উঠায়। এমন অভিযোগে সম্প্রতি আহাদ পুলিশ বক্স ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই ওবাইদুর রহমানকে বদলি করা হয়েছে। বছরের পর বছর ওই ফাঁড়িতে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।

গুলিস্তানের ফুটপাত ও সড়ক দখল করে বসানো দোকানগুলো অন্তত ৩০টি লাইনে বিভক্ত। একেক অংশে আলাদা নিয়ন্ত্রক ও লাইনম্যান রয়েছে। চাঁদাবাজি করতে হকার্স সমিতি নামে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠেছে।

রমনা ভবনের পাশের ফুটপাতের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চাঁদা না দিলে এখানে বসার কোনো সুযোগ নেই। আমি প্রতিদিন ২৫০ টাকা চাঁদা দিই। তবে চাঁদাবাজদের নাম বললে আমার ওপর তারা ক্ষুব্ধ হবে। এতে ক্ষতি হতে পারে আমার।’

গোলাপশাহ মসজিদের সামনে থেকে ওসমানী উদ্যানের পাশের ফুটপাত থেকে টাকা তোলে শাহীন। সেখানে প্রায় ১০০ দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকে ১২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলে সে। তাঁর সঙ্গে রয়েছে– আমীর, বাসু, সেলিম ও তছলিম। গোলাপশাহ মাজারের পূর্ব পাশ থেকে থেকে রমনা ভবনের দক্ষিণ পাশ পর্যন্ত চাঁদা তোলার দায়িত্বে লিপু ও সুলতান। সেখানেও আছে তিন শতাধিক দোকান । রমনা ভবনের পশ্চিম পাশে টাকা উঠায় আলী মিয়া, শফিক, জামাল ও সেলিম। খদ্দর বাজার শপিং কমপ্লেক্সের পশ্চিম ও উত্তর দিকের ফুটপাতে দুই শতাধিক দোকান রয়েছে। সেখানে লাইনম্যান হিসেবে চাঁদা তোলে কাদের ও রহিম। তাদের হোতা হান্নান। গুলিস্তানে হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে দোকান থেকে টাকা উঠায় লম্বা বাবুল, সালেহ ও রজ্জব। ঢাকা ট্রেড সেন্টারের পূর্ব পাশে চাঁদা তোলে নাসির। রাজধানী হোটেল থেকে বেল্টের গলি পর্যন্ত ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করে নুরুন্নবী। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছে সেলিম, জামাল ও কামাল। সোনালী ব্যাংকের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ শাখা থেকে উদয়ন মার্কেটের গলি পর্যন্ত টাকা উঠায় জুয়াড়ি সালাম।

আরও পড়ুন

×