সারি সারি বহুতল ভবন, কারও নেই অনুমোদন

রাজধানীর বছিলাজুড়ে এভাবেই গড়ে উঠেছে অবৈধ বহুতল ভবনের সারি। ছবি- সমকাল
অমিতোষ পাল
প্রকাশ: ১১ মে ২০২৪ | ০৭:৪৯ | আপডেট: ১১ মে ২০২৪ | ১০:৫৮
রাজধানীর বছিলায় গড়ে উঠেছে ‘মোহাম্মদপুর ফিউচার টাউন হাউজিং’। এ হাউজিংয়ের ‘ডি’ ব্লকের অ্যাভিনিউ রোডের ২ নম্বর প্লটে ‘সারা বিল্ডার্স’ নির্মাণ করছে ১৪ তলা ভবন। ছয় তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক, বাকিটা আবাসিক। ১৪ দশমিক ২৫ কাঠার ওপর ভবনটির আবাসিক ফ্লোরে রয়েছে চারটি করে ফ্ল্যাট। প্রতিটির আয়তন ১৫৬০ থেকে ১৬০০ বর্গফুট। ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক স্পেস বিক্রি চলছে ধুমধামে। বিস্ময়কর হলো, ভবনটির নির্মাণবিষয়ক বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে নকশার অনুমোদন নেয়নি। নেই অন্য কোনো সংস্থার অনুমতিও।
এ ব্যাপারে সারা বিল্ডার্সের প্রকল্প প্রকৌশলী সোলাইমান হোসেন জানিয়েছেন, বেড়িবাঁধের পশ্চিম পাশে যত ভবন হয়েছে, কোনোটির নকশা নেই। এখানে রাজউক তদারকি করে না। এ সুযোগ নিয়ে তারাও ভবন বানাচ্ছে। তবে রাজউক চাইলে কাগজপত্র দেখিয়ে নকশার অনুমতি নেওয়া হবে।
শুধু ফিউচার টাউনে নয়, গাবতলী-হাজারীবাগ বেড়িবাঁধের পশ্চিম পাশের বছিলা ও আশপাশের এলাকায় নামসর্বস্ব অনেক আবাসন কোম্পানি সারি সারি বহুতল ভবন করছে। সিটি করপোরেশনের আওতাধীন, মূল শহরের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ এবং দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় এখানকার প্লট-ফ্ল্যাট কেনার হিড়িক পড়েছে। অনেকে একা, আবার কয়েকজন মিলে প্লট কিনে ভবন বানিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রি করছেন। অনেক ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান প্লট কিনে ফ্ল্যাট বানিয়ে বিক্রির চটকদার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে।
জলাধার ভরাট করে অবৈধ ভবন
মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের বাইরে অবৈধ নগরায়ণ শুরু হয় নব্বই দশকে, ঢাকা উদ্যান দিয়ে। তখন ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানে (ডিএমডিপি) ওই এলাকা জলাধার হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এমনকি ২০১৩ সালে প্রণীত ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানেও (ড্যাপ) ওই এলাকার শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়নি। কিন্তু পর্যায়ক্রমে আশপাশের জলাশয়, বাগান ও খাল ভরাট করে শুরু হয় ভবন নির্মাণ। বিভিন্ন হাউজিং নাম দিয়ে ইচ্ছামতো রাস্তা-প্লট বানিয়ে কেনাবেচা করছে। যার জায়গা রাস্তার মধ্যে পড়ে, তাকে পাশেই প্লট দেওয়া হয়। ফলে খুব দ্রুত নগরায়ণ ঘটে বিস্তীর্ণ ওই এলাকায়।
বর্তমান ড্যাপ প্রণয়নের সময়ও পরিবেশবাদীরা এলাকাটি আরবান এরিয়া ঘোষণা করতে বাধা দেয়। এর পরও ২০২০ সাল থেকে ১৫ বছর মেয়াদি ড্যাপে এলাকাটি আরবান এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত করে রাজউক। এর পরই ভবন নির্মাণের মহোৎসব শুরু হয়। এ কাজে একতা হাউজিং, নবীনগর হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, সূচনা হাউজিং, দয়াল হাউজিং, বছিলা সিটি ডেভেলপার, গ্রিন হাউজিং, গ্রিনভিউ হাউজিং, ঢাকা উদ্যান, রাজধানী উদ্যান, স্বপ্নধারা হাউজিং, গার্ডেন হাউজিং, চাঁদ উদ্যান, চন্দ্রিমা হাউজিং, বছিলা হাউজিংসহ ডজনখানেক আবাসন কোম্পানি গড়ে উঠেছে। নীতিমালার তোয়াক্কা না করে জলাশয়, কৃষিজমি, ডোবা, বাগান ও নালা ভরাট করে চলছে আবাসন প্রকল্প। যারা এখানে জমির মালিক ছিলেন বা হয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই ভরাট এবং প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। যদিও তারা বিষয়টি স্বীকার করতে নারাজ।
স্বপ্নধারা হাউজিংয়ের প্লটে বাড়ি করা মোরশেদ আলম জানিয়েছেন, কেনার সময় তাঁর জমি সমতল ছিল, কোনো জলাশয় ছিল না।
অবৈধ স্থাপনা নিয়েও সাহসী মালিকরা
সরেজমিন মোহাম্মদপুরের বছিলাসংলগ্ন চাঁদ উদ্যানের সাতমসজিদ হাউজিংয়ের ২ নম্বর রোডের ১৩ নম্বর প্লটে একটি বহুতল ভবনের দৃষ্টিনন্দন ছবির সঙ্গে ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখা যায়। পাশেই আরেকটি ভবনের আট তলা পর্যন্ত অবকাঠামো হয়েছে। সমতা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ভবনের নাম দিয়েছে ‘সমতা গার্ডেন পার্ক’। সমতা কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসিম উদ্দিন বলেন, ঢাকা উদ্যান থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত হাজার হাজার ভবন হয়েছে। এত ভবন রাজউক ভাঙতে পারবে না। আমার বিশ্বাস, কিছু জরিমানা করে রাজউক বৈধতা দিতে বাধ্য হবে।
ঢাকা উদ্যান হাউজিং সোসাইটির সভাপতি আবু শাহীন বলেন, ঢাকা উদ্যানে ১১ শতাধিক প্লটের মধ্যে ছয় শতাধিকে উঠেছে ১২ থেকে ১৪ তলা ভবন। এত ভবন রাজউক কীভাবে ভাঙবে? ৪ এপ্রিল রাজউক আমাদের ডেকে নিয়ে এখন থেকে ৪০ শতাংশ জায়গা ফাঁকা রেখে বাড়ি তৈরি করতে বলেছে। এরই মধ্যে গড়ে ওঠা ভবন এ নিয়ম মানলে এবং মান ঠিক থাকলে উচ্চহারে জরিমানা করে তাদের বৈধতা দেবে।
ঢাকা উদ্যানে একাধিক প্লটের মালিক শ্যামল সাহা বলেন, এসব এলাকাও বসুন্ধরার মতো অবস্থা হবে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা তৈরির পর লোকজন ঘরবাড়ি তুলেছিলেন রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই। পরে রাজউক বৈধতা দিতে বাধ্য হয়েছে। এখানেও অনুমোদন দেওয়া ছাড়া তাদের হাতে কোনো বিকল্প নেই।
নেই খেলার মাঠ-পার্ক, মসজিদ-বাজার
এসব হাউজিংয়ের কার্যক্রম শুরু এবং ভবন তৈরির সময় রাজউক বাধা দেয়নি। ফলে খেলার মাঠ, পার্ক, উদ্যান, উন্মুক্ত স্থান, কাঁচাবাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশস্ত রাস্তা, স্যুয়ারেজ, ড্রেন, পানির সংযোগসহ নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কিছুই রাখেনি সংশ্লিষ্টরা। আছে শুধু প্লট আর প্লট, সেখানে উঠছে সারি সারি বহুতল ভবন। এসব হাউজিংয়ে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ। কিছু পানির লাইনও হয়েছে। তবে বেশির ভাগ ভবনমালিক গভীর নলকূপ বসিয়ে পানির চাহিদা পূরণ করছেন।
সম্প্রতি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডের পর রাজউক থেকে ভবনে বিদ্যুতের নতুন সংযোগ না দিতে বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দেয়। এর পর থেকে বছিলা এলাকার ভবনে বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। এতে অনেকে পড়েছেন বিপাকে।
রাজধানী উদ্যানের হাউস ৩/১ বছিলা রোডে গিয়ে দেখা যায়, একটি ভবন করছে আল করিম হোমস লিমিটেড। সেখানেও ফ্ল্যাট বিক্রির চটকদার বিজ্ঞাপন। আল করিম হোমস লিমিটেডের মালিক ফজলুল করিম বলেন, এখানে খেলার মাঠ, পার্ক নেই। হাউজিং কোম্পানিগুলো মসজিদের জন্যও জায়গা রাখেনি। পানির পাম্পের জায়গা নেই। তারা প্লট বেচে পালিয়ে গেছে।
কীভাবে দেখছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, চোখের সামনে বিশাল জলাধারপ্রবণ এলাকা ভরাট করে হাজারো বহুতল ভবন হলেও রাজউক নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এটি ছোটখাটো বিষয় নয়, এখানে সম্পূর্ণ ব্যর্থতা রাজউকের। যেসব চেয়ারম্যান ও বোর্ড সদস্যের আমলে এ ঘটনা ঘটেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা দরকার। কারণ দায়িত্বে থেকেও তারা না দেখার ভান করেছেন। এখন মানুষ ভাবতে শুরু করেছে, নকশা ছাড়া ভবন করলে কিছুই হয় না। তিনি বলেন, বেড়িবাঁধের বাইরে নকশাবিহীন ভবন নির্মাণ, এরপর সেখানে বিশাল জনপদ হলেও নেই খেলার মাঠ, পার্ক কিংবা বাজার। এখান থেকে ভবিষ্যতে একটি ‘বিকলাঙ্গ প্রজন্ম’ তৈরি হবে। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, রাজউক ভাঙতে না পেরে হাজার হাজার ভবনের বৈধতা দেবে। এতে প্রতিষ্ঠানটির লোকজনের বাণিজ্য করার সুযোগ তৈরি হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন বলেন, বছিলা এলাকার ১৫টি হাউজিং কোম্পানিকে বৈধতা না দিতে আমরা দাবি করেছিলাম। রাজউকও নিষেধাজ্ঞা দেয়। সব ভবনই যেখানে অবৈধ, সেখানে নাগরিক সুবিধা আসবে কীভাবে? যারা জমির মালিক কিংবা প্লট কিনেছেন, তারা কেবলই মুনাফা খুঁজছেন। তারা ধরেই নিয়েছেন, এখানে কেবল মানুষই থাকবে। এসব প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিকরা প্রকারান্তে ভূমিদস্যু। এখনও ফাঁকা জায়গাগুলো ড্রেজিংয়ের সাহায্যে নিয়মিত ভরাট করা হচ্ছে। রাজউক তাদের কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করছে না।
জানতে চাইলে রাজউকের মুখপাত্র ও প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীর অদূরদর্শিতার কারণে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। খাল ও হালট দখল করে গড়া ভবন অপসারণ করার চিন্তা চলছে। ল্যান্ড রিঅ্যাডজাস্টমেন্ট টেকনিক পদ্ধতির মাধ্যমে পুরো এলাকা পরিকল্পনার মধ্যে আনা হবে। জরিমানা করে ইমারত নির্মাণ আইনের আওতায় কিছু ভবনের বৈধতা এবং বাকিগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। বছিলা এলাকা কীভাবে পরিকল্পনার মধ্যে আনা যায়, সে জন্য শিগগির বৈঠক হবে। সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে বৈঠক করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কারণ এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। মনে হচ্ছে, ভবনগুলো হয় ভেঙে ফেলতে হবে, না হলে জরিমানা দিয়ে যেগুলোর বৈধতা দেওয়া যায়, তা দেওয়া হবে।