পাঁচ বছরেও শুরু হয়নি শিশু পার্কের কাজ
শাহবাগ থানা স্থানান্তরে মুক্তিযুদ্ধ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পাল্টাপাল্টি চিঠি

ফাইল ছবি
লতিফুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৪ | ০০:৪২ | আপডেট: ২৩ মে ২০২৪ | ০৭:৩৬
উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের বিজ্ঞপ্তি সেঁটে দিয়ে রাজধানীর শাহবাগের শিশু পার্কটি ২০১৯ সালে বন্ধ করে দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। তবে পাঁচ বছর পার হলেও পার্কটির কাজই শুরু হয়নি। অর্থ সংস্থানে জটিলতা, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় আর ডিএসসিসির ঠেলাঠেলির পর এখন কাজ শুরু আটকে আছে শাহবাগ থানা স্থানান্তর প্রক্রিয়ার গ্যাঁড়াকলে।
মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, শিশু পার্কের কাজ শুরুর আগেই শাহবাগ থানা সরিয়ে নিতে হবে। তবে থানা সরে কোথায় যাবে– সেটির কিনারা এখনও হয়নি। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় আর ডিএসসিসির চিঠি চালাচালি আর একের পর এক সভা করেও সমাধান বের করা যায়নি।
এ পটভূমিতে শিশু পার্কের উন্নয়নকাজ কবে শুরু হবে, সেই উত্তর কারও কাছে নেই। এরই মধ্যে ২০২১ সালে জিয়া শিশু পার্কের নাম বদলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশু পার্ক করে ডিএসসিসি।
এদিকে, শাহবাগ থানার স্থানান্তর নিয়ে সমস্যা সমাধানের আগেই আগামী শনিবার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশু পার্কের আধুনিকীকরণ কাজের উদ্বোধন করার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্প থেকে ২৬৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা শিশু পার্কটির আধুনিকায়নের জন্য বরাদ্দের ব্যাপারে ডিএসসিসিকে প্রস্তাব দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে এ টাকা যথেষ্ট মনে না করায় ডিএসসিসি এতে আপত্তি জানায়। এ নিয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একাধিকবার যোগাযোগও হয়। পরে ডিএসসিসিকে নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে শিশু পার্কের কাজ এগিয়ে নিতে বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
পরে ডিএসসিসি নতুন বাজেটে প্রকল্প তৈরি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ৬০৩ কোটি টাকার প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হয়। এ বাজেটের ৮০ শতাংশ জিওবির ৪৮৩ কোটি টাকার মধ্যে সরকার অর্ধেক অনুদান দেবে। বাকি অর্ধেক ৫ শতাংশ সুদে সরকারের কাছ থেকে ঋণ নেবে ডিএসসিসি। এর মধ্যে চলতি মাসের মাঝামাঝি ঋণের জন্য সরকারের সঙ্গে ডিএসসিসির চুক্তি সই হয়।
প্রকল্প অনুমোদনের পর মহাপরিকল্পনা ধরে পার্কের নকশা প্রণয়ন করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের মাধ্যমে কাজ শুরুর নির্দেশ দিয়েছে ডিএসসিসি। তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) কাজ এখনও শেষ না হওয়ায় এবং শাহবাগ থানা ও পুলিশ কন্ট্রোল রুম স্থানান্তর করতে না পারায় নির্মাণকাজে হাত দিতে পারছে না সংস্থাটি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স প্ল্যানিং (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘বাস্তবতা হলো, ঢাকায় শিশুদের জন্য তেমন উল্লেখযোগ্য বিনোদন কেন্দ্র নেই। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন পার্কটি বন্ধ থাকা সত্যিই দুঃখজনক। পার্কের আধুনিকায়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগেই এটি কীভাবে দ্রুত সম্পন্ন করা যায়, তা চিন্তা করা প্রয়োজন ছিল।’ তিনি বলেন, ‘এটিকে শুধু বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে না দেখে শিশুদের মানসিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র হিসেবে দেখা উচিত এবং সেই গুরুত্ব থেকেই দ্রুত এই পার্কের শিশুবান্ধব সংস্কারের প্রত্যাশা করছি।’
শিশু পার্কের প্রকল্প পরিচালক ও ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনিছুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘আগে পার্কটির অর্থায়ন নিয়ে সংকট ছিল। তবে গত বছর একনেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশু পার্কের নামে ৬০৩ কোটি টাকা অনুমোদন হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিক ও যুগোপযোগী ১৫ ধরনের রাইডস স্থাপন করা হবে। আমরা এরই মধ্যে দরপত্রের মাধ্যেম ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কাজ শেষে জায়গা বুঝিয়ে দিলে আমরা কাজ শুরু করব।’
স্বাধীনতা স্তম্ভ প্রকল্পসূত্রে জানা যায়, শিশু পার্ক এলাকার ভেতরেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় আন্ডারগ্রাউন্ড গাড়ি পার্কিংয়ের কাজ চলছে। কার্যাদেশ অনুযায়ী প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়ে ২০১৯ সালেই শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা সময় বাড়িয়ে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, শিশু পার্কের মাঝামাঝি ভূগর্ভে গাড়ি পার্কিং নির্মাণ, ভূগর্ভে জলাধার, ভূগর্ভে আন্ডারপাস, হাঁটার পথ এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে এখনও শিশু পার্কের ভেতরে হাঁটার পথ এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণকাজ শেষ হয়নি।
এদিকে, গত ৩ জানুয়ারি ডিএসসিসি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শাহবাগ থানা ও পুলিশ কন্ট্রোল রুমের জায়গা ডিএসসিসির কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে। সংস্থাটি ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে জমি পেতে আরেকটি চিঠিও দেয়। তবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ডিএসসিসির কাছে উল্টো শাহবাগ থানা স্থানান্তর করতে পরীবাগের সাকুরা মার্কেটের জায়গা চেয়ে চিঠি দেয়। তবে সাকুরা মার্কেটের জায়গায় ডিএসসিসির ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় আর বর্তমান মার্কেট ভেঙে ২০ তলা ভবন নির্মাণের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ায় ডিএসসিসি এ প্রস্তাব নাকচ করে।
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থানা করতে সাকুরা মার্কেটের জায়গা নির্দিষ্ট করায় এটি নিয়ে আলোচনা করতে মন্ত্রিসভার বৈঠকে নথি পাঠানো হয়েছে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে।’ এ পরিস্থিতিতে কবে নাগাদ শিশু পার্কের কাজ শুরু হবে, তা অনিশ্চিত। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ভালো একটি কাজের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে প্রকল্পের নির্দিষ্ট মেয়াদেই কাজ শেষ করে আমরা পার্কটি শিশুদের জন্য উপহার দিতে পারব।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব (পুলিশ-১ অধিশাখা) আবুল ফজল মীর সমকালকে বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রকল্পটি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করছে। তারা আমাদের যেখানে জায়গা বুঝিয়ে দেবে, আমরা সেখানে থানা স্থানান্তর করব।’
স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. হাবিবুল ইসলামের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলে তিনি ধরেননি।
- বিষয় :
- শিশু পার্ক