ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

কী ঘটেছিল রাজের সঙ্গে

কী ঘটেছিল রাজের সঙ্গে

মো. রাজ

 ইন্দ্রজিৎ সরকার 

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪ | ০০:০০

বেগুনি শার্ট ও সাদা প্যান্ট পরে বসে আছেন এক তরুণ। তাঁর নাক-মুখে লেগে আছে তাজা রক্ত। হাতজোড় করে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছেন তিনি। উপস্থিত একজন একদিকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন, আবার কিছু বলার জন্য জবরদস্তিও করছেন। তখন ওই তরুণ কাতর কণ্ঠে বলছেন, ‘আপনারা যা বলতে বলবেন, আমি তাই বলব। তবু আমাকে ছেড়ে দেন।’ সমকালের হাতে আসা এক ভিডিওতে এভাবেই কথা বলতে দেখা যায় মো. রাজ নামের ওই তরুণকে। পরে যাকে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় র‍্যাব। 
স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, রাজ কখনও মাদক কারবারে যুক্ত ছিলেন না। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা অভিযোগও নেই। তিনি মোটরসাইকেল মিস্ত্রি। গত ১৬ জুন রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে তাঁকে তুলে নেয় কয়েকজন। পরে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে নিয়ে তাঁকে বেধড়ক পেটানো হয়। এক পর্যায়ে পিটুনি সহ্য করতে না পেরে তিনি ‘সাজানো’ বক্তব্য দিতে রাজি হন। শেষে তাঁকে হেরোইনসহ র‍্যাবের হাতে তুলে দেয় চিহ্নিত মাদক কারবারিরা। আদতে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবারি মো. সেলিম ওরফে চুয়া সেলিমের লোক সন্দেহে রাজকে ধরিয়ে দেন আরেক মাদক কারবারি সোহেল ওরফে ভূঁইয়া সোহেল।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্থানীয় ইউনিটের সদস্যদের সঙ্গে সোহেলসহ অন্য মাদক কারবারির যোগসাজশ রয়েছে। প্রায়ই কারবারিরা প্রতিপক্ষের লোকদের নানাভাবে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে। 

এ ঘটনায় র‍্যাবের দায়ের করা মামলার তথ্যেও রয়েছে অসংগতি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, রাজকে গাবতলী থেকে তুলে আনার পর বাবর রোড থেকে নিয়ে যায় র‍্যাব। অথচ এজাহারে বলা হয়েছে, খিলজি রোড থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। 
এ বিষয়ে র‍্যাব-২-এর অধিনায়ক আনোয়ার হোসেন খান বলেন, নিরীহ কেউ ঘটনাচক্রে গ্রেপ্তার হয়ে থাকলে তা খুবই দুঃখজনক। আমরা অবশ্যই পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখব। 
বর্তমানে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন রাজ। তাঁর মা শর্বরী বেগম জানান, জেনেভা ক্যাম্পে পরিবারের সঙ্গেই থাকে তাঁর ছেলে। গত তিন মাসে ক্যাম্পে মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একাধিক গ্রুপ দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়ায়। আধিপত্যের বিস্তার নিয়ে মূলত মাদক কারবারিরা সংঘর্ষে জড়ালেও পরে ক্যাম্পের বাসিন্দা সাধারণ তরুণরাও কোনো একটি পক্ষ নিয়ে ফেলেন। তেমনই এক সংঘর্ষের দিন মাদক কারবারি সেলিমের পক্ষের লোকজনের সঙ্গে ছিলেন রাজ। এতে তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হন আরেক কারবারি সোহেল। এর জের ধরে কোরবানির ঈদের আগের রাতে রাজকে মাদক কারবারি সাজিয়ে ধরিয়ে দেওয়া হয়। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৬ জুন দুই বন্ধুসহ গাবতলীতে থেমে থাকা একটি মিনিবাসে ওঠেন রাজ। রাত ৯টার দিকে সোহেলের ভাই কালুসহ বেশ কয়েকজন সেখানে গিয়ে তাঁকে আটক করে। তখন উপস্থিত লোকজন কারণ জানতে চাইলে তারা জানান, রাজের কাছে ৫ লাখ টাকা পাওনা আছে। এর পর তাঁকে পেটাতে পেটাতে জেনেভা ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টরে নেওয়া হয়। সেখানেই সোহেল ও তাঁর সহযোগীদের বাসা। ক্যাম্পে নেওয়ার পর সোহেল, তাঁর ভাই টুনটুনসহ অন্যরা তাঁকে বেধড়ক পিটিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা চালান। 
সমকালের কাছে থাকা একাধিক ভিডিওতে বাধ্য হয়ে দেওয়া রাজের মিথ্যা বয়ান, ছেড়ে দেওয়ার শর্তে যে কোনো কিছু বলতে রাজি হওয়া এবং নির্যাতনের স্পট থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের দৃশ্য রয়েছে। 

গাবতলীতে হানিফ পরিবহনের কাউন্টারের পাশের দোকানের কর্মী এক তরুণ জানান, রাজের কাছে ৫ লাখ টাকা পান দাবি করে বেশ কয়েকজন তাঁকে মারধর করেন এবং তুলে নিয়ে যান।  
এদিকে এজাহারে ঘটনার সাক্ষী হিসেবে খিলজি রোডের গ্রিন ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল সার্ভিসের নিরাপত্তাকর্মী সোনাই মল্লিকের নাম রয়েছে। তিনি বলেন, কোথায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা জানি না। তবে এখানে রাজকে গাড়ি থেকে নামিয়ে র‍্যাব জানায়, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো। পরে কাগজে আমাদের সই নেয়। 
মামলার বাদী ও র‍্যাব-২-এর সদর কোম্পানির এসআই জাহিদুল ইসলাম দাবি করেন, খিলজি রোড থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজকে নির্যাতন বা গাবতলী থেকে তুলে আনার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তবে প্রত্যক্ষদর্শীর ভিন্ন বক্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি।

আরও পড়ুন

×