ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

অনেক এলাকায় কোমরপানি

বৃষ্টিতে ভাসল রাজধানী অবর্ণনীয় দুর্ভোগ

১৫ মিনিটের কথা বলা হলেও পানি সরে না ১৫ ঘণ্টায়

বৃষ্টিতে ভাসল রাজধানী অবর্ণনীয় দুর্ভোগ

সকালের টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকা। ছুটির দিনে ঘর থেকে বের হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। শুক্রবার নয়াপল্টন এলাকায়- মামুনুর রশিদ

 জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৪ | ০০:৫৬

অল্প সময় ভারী বৃষ্টি হলেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। চরম ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী। সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্টরা দেন নানা আশ্বাস। তবে গত এক যুগে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও সমস্যার সমাধান মেলেনি। প্রতিবছরের মতো এবারও ভাসল নগরী। আষাঢ়ের শেষ সময়ে গতকাল শুক্রবার ভোর থেকে প্রায় ছয় ঘণ্টার বর্ষণে নাকাল হলো জনজীবন। বড় ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের।
টানা বৃষ্টিতে রাজধানীর বড় একটি অংশ ছিল পানির নিচে। প্রধান প্রধান সড়ক, অলিগলি ও ফুটপাতে কোমরপানি দেখা গেছে। পানি ঢুকে যায় দোকানপাট, অফিস ও বাসাবাড়িতেও। এতে নষ্ট হয়েছে আসবাবসহ নানা পণ্য। শুধু নিউমার্কেটেই কয়েক কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। রাস্তায় বের হওয়া প্রাইভেটকার, অটোরিকশা বিকল হয়ে পড়ে। ছুটির দিনে মানুষের তেমন কর্মব্যস্ততা না থাকায় রাস্তায় রাস্তায় যানজট না হলেও বিভিন্ন কাজে যারা ঘর থেকে বের হন, তারা বিপাকে পড়েন। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল, ঢাকা মহানগর পুলিশ নগরবাসীর চলাফেরায় সতর্কতা জারি করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছয়টি সংস্থা ও বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ হওয়ার কথা। কিন্তু সংস্থাগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানের ওপর দায় চাপায়। জলাবদ্ধতা নিরসনে বছর বছর টাকা খরচ হলেও পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সংস্থাগুলো কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে।

নগরীর বড় অংশ পানির নিচে
গতকাল সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় ৬ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ১৩০ মিলিমিটার। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ বলেন, তারা ছয় ঘণ্টা পর পর মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রকাশ করেন। দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ১ মিলিমিটার। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সকালের দিকে ভারী বৃষ্টি হয়েছে ৩ ঘণ্টা।
নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে প্রায় সব এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। বিকেল ৫টায়ও গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়কে পানি ছিল। নিউমার্কেট এলাকায় সন্ধ্যা ৭টায় পানি পুরোপুরি নামেনি। বিকেল ৩টার দিকে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কে কোমরপানি ছিল। কয়েকটি গাড়ি বিকল হয়ে পড়ায় এ সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের সড়কেও হাঁটুপানি ছিল তখন। যানজট ছিল মহাখালী থেকে বিজয় সরণি যাওয়ার পুরো পথেই। 

মতিঝিলের শাপলা চত্বর এলাকায় ছিল কোমরপানি। বৃষ্টিতে কাকরাইল, মোহাম্মদপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়াসহ মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা এবং মিরপুরে মাজার রোড, এলিফ্যান্ট রোড, মৎস্য ভবন, সেন্ট্রাল রোড, ধানমন্ডির ২৭ নম্বর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, তেজগাঁও, বিজয় সরণি, পশ্চিম তেজতুরী বাজার, তেজকুনিপাড়া, দক্ষিণ মনিপুরের মোল্লাপাড়া, মহাখালীর বিভিন্ন রাস্তায় পানি জমে যায়। এ ছাড়া শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, কাকরাইল, নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন, আরামবাগ, শাহজাহানপুর, ফকিরাপুল, বিজয়নগর সড়কে পানি ওঠে। তলিয়ে যায় দয়াগঞ্জ মোড়, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, নিমতলী, কমলাপুরের কাছে টয়েনবি সার্কুলার রোড, যাত্রাবাড়ী, কাজলা, শনির আখড়া, রায়েরবাগ, গোলাপবাগের নিচু এলাকাসহ বিভিন্ন স্থান।

বড় ক্ষতি ব্যবসায়ীদের
বিকেলে মহাখালী দক্ষিণপাড়ায় ছিল কোমরপানি। এই এলাকায় সড়কের পাশে দোকানপাট এবং কোনো কোনো ভবনের নিচতলায়ও পানি ঢুকেছে। এলাকার মাহবুব জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী মাহবুবুল আলম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘কিছুদিন আগে দোকানের সামনে কিছু অংশ পাকা করে দিয়েছিলাম। তাতে লাভ হয়নি। কোমরপানি দোকানে। মালপত্র সব ভিজে গেছে। বড় ক্ষতি হলো আমার। এত উন্নয়নের কথা বলা হয়, অথচ সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে, বাসাবাড়িতে ঢুকে যায়।’

নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় থেকে শুরু করে নীলক্ষেত পর্যন্ত সড়কে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত জমে ছিল পানি। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েন রাস্তার পাশে অপেক্ষাকৃত নিচু ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। বৃষ্টির পানি প্রবেশ করায় দোকানগুলোয় শাড়ি, অন্যান্য কাপড়, বই, জুয়েলারিসহ অনেক পণ্য ভিজে গেছে। সব মিলিয়ে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের।

বিকেলে দেখা গেছে, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি নায়েম রোড, ঢাকা কলেজের আবাসিক এলাকা, আজিমপুর কবরস্থান সংলগ্ন এলাকায় হাঁটুপানি। রাস্তায় ও গলিতে পানি জমে থাকার এলাকার অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। ব্যবসায়ীরা বলেন, অধিকাংশ পণ্যই পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে।

৩ হাজার কোটি টাকা খরচায়ও ভাসছে নগরী
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে গত ২৭ মে রাজধানীতে এক দিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছিল ২২৪ মিলিমিটার। গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর রাতে ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ডুবে গিয়েছিল রাস্তাঘাট, মারা যান চারজন। ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর ঢাকায় পুরো দিনে ২৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। এবারের বৃষ্টির একটি দিক হলো, এটি হয়েছে ৬ ঘণ্টায়। এর আগে ২০১৭ সালের ১২ জুন ঢাকায় ১৫৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। নিকট অতীতে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতা হয়েছিল ২০১৭ সালে। ওই সময় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘আমি প্রমিজ করছি, সামনের বছর থেকে আর এসব (জলাবদ্ধতা) দেখবেন না। কিছুদিনের মধ্যেই নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে।’ এ ঘোষণার পর সাত বছর পেরিয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে এসেছেন নতুন মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। ঢাকা ওয়াসার হাত ঘুরে জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব গেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাছে। খাল খনন ও নর্দমা নির্মাণে দুই সিটি করপোরেশন শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেছে। কিন্তু জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসী মুক্তি পাননি, বরং জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে ঢাকার মেয়ররা সাফল্যের দাবি করছেন। গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস পুরান ঢাকার ওয়ারীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘চলতি বছর বর্ষায় অতিবৃষ্টি হলেও ১৫ মিনিটের মধ্যে পানি নিষ্কাশন হবে।’ কিন্তু রাজধানীতে বৃষ্টি হলে কোনো কোনো এলাকায় পানি ২৪ ঘণ্টায় সরে না।

ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, গত এক যুগে জলাবদ্ধতা নিরসনে কমপক্ষে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দায়িত্ব পাওয়ার পর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন তিন অর্থবছরে ব্যয় করেছে অন্তত ৭০০ কোটি টাকা।

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির জন্য মন্ত্রীসহ বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিরা যে আশ্বাস দেন, তার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। তারা নিজেরাও জানেন না, ঢাকায় কত মিলিমিটার বৃষ্টি হলে কোন অংশে কতটুকু জলাবদ্ধতা হবে। এ থেকে রক্ষার জন্য তারা সেভাবে কাজও করছেন না। বিভিন্ন সংস্থা বিচ্ছিন্নভাবে প্রকল্প নিয়ে যে কাজ করছে, তাতে শুধু জনগণের টাকাই নষ্ট হচ্ছে, প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং জলাশয় অবশিষ্ট আছে, সেগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোকে জলাশয় ভরাট করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

ভোগান্তি হতে পারে আজও
আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল জানিয়েছে, রাজধানীবাসীর ভোগান্তি সহসা কমবে না। আগামী ২৪ ঘণ্টা ঢাকাসহ সারাদেশে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। একটানা না হয়ে থেমে থেমে মাঝারি থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, এখন আষাঢ়ের শেষ ভাগ চলছে। এই সময় এ রকম বৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই হয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি থেকে প্রবল অবস্থায় রয়েছে। এ কারণে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা বলেন, শনিবার (আজ) বিকেল পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। এর পর থেকে বৃষ্টি কমবে।

 

আরও পড়ুন

×