দিনভর রণক্ষেত্র মিরপুর

রণক্ষেত্রে পরিণত মিরপুর ১০ নম্বর। ছবি-সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৪ | ০৩:১১ | আপডেট: ০৫ আগস্ট ২০২৪ | ০৮:০২
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির প্রথম দিনে গতকাল রোববার রণক্ষেত্রে পরিণত হয় মিরপুর ১০ নম্বর এলাকা। সকাল থেকে মিরপুরের সব ওয়ার্ড ও থানা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ১০ নম্বর গোলচত্বরে অবস্থান নেন। তাদের অনেকের হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র, লাঠি ও হকিস্টিক। এক পর্যায়ে পাঁচশর মতো আন্দোলনকারী অদূরে অবস্থান নিলে তাদের ধাওয়া দেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে সংঘর্ষ বেধে যায়। চলতে থাকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ। এ সময় একের পর এক ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে এবং গুলি ছোড়া হয়। দিনভর চলা সংঘর্ষে একজন নিহত ও তিন শতাধিক আহত হয়েছেন।
বিকেলে স্থানীয় অনেক লোক আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দিলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী আর পুলিশ পিছু হটতে বাধ্য হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ফাঁকা গুলি ছোড়েন। সন্ধ্যার দিকে আন্দোলনকারীরা মিরপুর মডেল থানা ঘেরাও করলে পুলিশ গুলি চালায়। রাতে সেনাবাহিনী গোলচত্বর এলাকা ঘিরে ফেলে। এ সময় আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন গলিতে অবস্থান নেয়।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল ইসলাম খান নিখিল, সাবেক সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার, ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নাম কচি ও স্থানীয় কাউন্সিলররা সেখানে অবস্থান নেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিসোটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এ সময় ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলি ছুড়তে থাকলে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোটা এলাকা। সড়কের মধ্যে একটি প্রাইভেটকারের ভেতরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তাদের বন্দুকে গুলি ভরেন। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আরও কয়েক হাজার তরুণ যোগ দিলে তারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তে থাকেন।
দুপুর ২টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর সঙ্গে পুলিশ যোগ দিলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়। এ সময় পুলিশ রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড ও শর্টগানের গুলি ছোড়ে। সাড়ে ৩টার দিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষ নেমে এলে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পিছু হটে। পুরো এলাকা আন্দোলনকারীরা নিয়ন্ত্রণে নেয়। পরে সেনাবাহিনী এই এলাকায় অবস্থান নিলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়।
সন্ধ্যা ৬টার দিকে আন্দোলনকারীরা মিরপুর মডেল থানা ঘেরাও করলে তাদের ওপর পুলিশ আবার গুলি চালায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলে। এ সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা ফাঁকা গুলি ছোড়েন এবং পুরো এলাকা ঘিরে ফেলেন। এলাকার পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আলোক হেলথকেয়ার অ্যান্ড হাসপাতাল, ডা. আজমল হাসপাতাল আর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, আহত অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। পপুলার ডায়াগনস্টিকে ৫০ জন, অলোকে ১০০ জন, আজমলে ৪০ জন এবং ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ১৫০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে আজমল হাসপাতালে নেওয়ার আগে মিরপুর ৬ নম্বরের ঝিলপাড় বস্তির টাইলস মিস্ত্রি মিরাজ হোসাইন (১৭) মৃত্যুবরণ করে।
পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের জনসংযোগ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা শুধু ছররা গুলিতে আহত ৫০ জনের মতো রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছি। আরও রোগী এলে ক্যাপাসিটি না থাকায় অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছি।’ আলোক হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মুশফিক বলেন, ‘আমাদের এখানে বিকেল পর্যন্ত যারা এসেছেন, তাদের অধিকাংশ গুলিবিদ্ধ। ছররা গুলিতে আহতও ছিল। ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের ডা. সাফাত আল নোমানী বলেন, ‘দুপুর ১২টার পর থেকে আমাদের হাসপাতালে রোগী আসা শুরু করে। প্রথমে ৮২ জনের নাম রেজিস্টারে তুলেছি। পরে এত রোগীর চাপ ছিল, আর রেজিস্টারে তুলিনি। তবে পরে ৭০ জন রোগী এসেছেন। এর মধ্যে তিন থেকে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের সোহরাওয়ার্দী ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বেশির ভাগের শরীরে রাবার বুলেট। অনেকে গুলিবিদ্ধও ছিল।’
ড. আজমল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক অঞ্জিলা সমকালকে বলেন, ‘দুপুর আড়াইটা থেকে ৪টা পর্যন্ত আমাদের এখানে আহত ৫০ জন এসেছেন। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই বুলেট ও ছররা গুলিতে আহত। তবে কয়েকজন সরাসরি গুলিতে আহত হয়েছেন। আবার কেউ ইটের আঘাতে আহত হয়েছেন। মিরাজ হোসেনের বুকে বুলেট লেগে ফুসফুস ভেদ করে চলে গেলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।’
মিরাজ হোসেনের ভাগনে ফয়সাল বলেন, মিরাজ আন্দোলনকারী নন। কাজে যাওয়ার সময় আজমল হাসপাতালের সামনের গলিতে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীর গুলিতে মারা গেছেন। তখন সেখানে পুলিশ ছিল না।’