রণক্ষেত্র ফার্মগেট-কারওয়ান বাজার

ছবি-সমকাল
সমকাল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৪ | ০৫:২২
সরকার পতনের এক দফা দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দফায় দফায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় গতকাল রোববার রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রাজধানীর ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার এলাকা। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে বাংলামটর এলাকায়। আন্দোলনকারীরা বাংলামটর থেকে ফার্মগেটের দিকে এগোতে থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কারওয়ান বাজারে তাদের বাধা দেয়। এতে সেখানে দু’পক্ষের সংঘর্ষ বাধে। পরে আন্দোলনকারীরা ফার্মগেটে পৌঁছলে সেখানে আরেক দফা সংঘর্ষ হয়। আন্দোলনকারীরা ইটপাটকেল ছোড়ে এবং বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর চালায়, আগুন ধরিয়ে দেয়। অন্যদিকে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ছোড়ে পুলিশ। বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলিও ছোড়া হয়। এতে ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার এলাকায় অন্তত দু’জন নিহত এবং পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন।
সকাল থেকে মগবাজার মোড়ের কাছে অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ এবং দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে আন্দোলনকারীরা ছিলেন বাংলামটর মোড়ে। দুপুর ১২টার দিকে তাদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। তবে কিছুক্ষণ পরই শাহবাগ থেকে বিপুল সংখ্যক আন্দোলনকারী এসে ধাওয়া দিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীদের সরিয়ে দেন। সোয়া ১টার দিকে তাদের একটি দল লাঠিসোটা নিয়ে নিউ ইস্কাটন সড়ক ধরে এগোতে থাকে। এ সময় তারা বন্ধ থাকা দোকানপাটের সামনের অংশে ভাঙচুর চালান। এক পর্যায়ে তারা এবিসি ক্রিসেন্ট টাওয়ারে হামলা চালান। ওই ভবনে থাকেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। বিক্ষোভকারীরা ভবনটির ফটক ও নিচতলায় থাকা ছয়টি গাড়িসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাঙচুর করেন। তারা সাদ্দামের ফ্ল্যাটে যেতে চাইলে বাসিন্দারা জানান, শনিবার রাতেই তিনি সপরিবারে বাসা ছেড়েছেন। এ সময় তারা ভবনটির সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও সংরক্ষণে ব্যবহৃত ডিভিআর (ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার) নিয়ে পুড়িয়ে দেন। এর পর বেরিয়ে এসে বাংলামটরে অবস্থান নেন। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসে টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে তাদের হটিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর তারা আবার জড়ো হলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মগবাজারের দিক থেকে এসে তাদের ধাওয়া দেন। এভাবে ঘণ্টাখানেক ধরে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি চলে। এর মধ্যে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানো হয় বলে জানান তারা। পরে বিকেল ৩টার দিকে রামপুরা বাড্ডা এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীসহ হাজার হাজার আন্দোলনকারী মগবাজার হয়ে বাংলামটরে এসে জড়ো হন। তারা আশপাশের সব সড়কে ছড়িয়ে পড়েন।
বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও গণভবন ঘেরাওর উদ্দেশ্যে মিছিল নিয়ে ফার্মগেটের দিকে অগ্রসর হন। কারওয়ান বাজার মোড়ে তাদের বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিক্ষোভকারীরা তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে, ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালান। এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ছোড়ে। তবে এভাবে তাদের বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। বিক্ষোভকারীরা আরও এগিয়ে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফার্মগেট মোড়ে অবস্থান নেয়। তাদের পাশেই ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। বিক্ষোভকারীরা সেখানে উপস্থিত হলে ফের শুরু হয় সংঘর্ষ। বিকেল ৫টা পর্যন্ত টানা চলে টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট। মাঝেমধ্যে গুলির আওয়াজও পাওয়া যায়। তবে গুলি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নাকি অন্য কেউ ছুড়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, বিভিন্ন ভবনের ছাদ থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে। ওই সময় মুহুর্মুহু গুলি গ্রেনেডের শব্দে প্রকম্পিত হয়ে পড়ে পুরো এলাকা। ছয় সাতজন বিক্ষোভকারীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেখা যায়। বিকেল ৫টার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া দিয়ে কারওয়ান বাজারের দিকে সরিয়ে দেন। পরে তারা আরও অগ্রসর হলে বাংলামটরে বিক্ষোভকারীদের প্রতিরোধের মুখে পড়েন। সেখানেও দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা শাহবাগের দিকে ফিরে যান।
এদিকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বাংলামটরের রূপায়ণ টাওয়ারে হামলা চালান আন্দোলনকারীরা। ওই ভবন থেকে গুলি ছোড়ার অভিযোগ তুলে তিন তলা পর্যন্ত ভাঙচুর চালানো হয়। চার তলায় দৈনিক দেশ রূপান্তরের কার্যালয়েও হামলা চালায় তারা। এ ছাড়া বেজমেন্টে থাকা একাধিক গাড়িতে ভাঙচুর ও নিচতলায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর আগে বিকেল ৪টার দিকে ফার্মগেটের কাছে ডেইলি স্টার পত্রিকা এবং ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কার্যালয় এনএলআই টাওয়ারে ভাঙচুর করা হয়।
কারওয়ান বাজার ফার্মগেট এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালে একদল অস্ত্রধারীকে বাংলামটর এলাকায় এলোমেলো গুলি ছুড়তে দেখা যায়। তারা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের কর্মী বলে দাবি প্রত্যক্ষদর্শীর।
তিন লাশ নিয়ে মিছিল
রাজধানীতে সংঘর্ষে নিহত তিনজনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কিছুক্ষণ রাখা হয়। পরে শাহবাগ পর্যন্ত লাশ নিয়ে মিছিল করেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় শাহবাগ থানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করায় পুলিশ টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ছোড়ে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে পৌনে ৭টা পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ অ্যাকশনে গেলে বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে কাঁটাবন ও মৎস্য ভবনের দিকে চলে যান। আন্দোলনকারীরা জানান, কারওয়ান বাজারে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর হামলায় ওই তিনজন নিহত হন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল থেকে শাহবাগ থানার সামনে অবস্থান করছিল পুলিশ। সন্ধ্যা ৬টার দিকে কর্মসূচি শেষ করে শাহবাগ মোড় ছাড়তে শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। তখন পুলিশ থানার ভেতরে চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পর ঢামেক থেকে তিনটি লাশ নিয়ে শহীদ মিনারে কিছুক্ষণ মিছিল করার পর বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দিতে দিতে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন। এ সময় তাদের একটি অংশ শাহবাগ থানায় ইটপাটকেল ছোড়ে। তারা থানার সামনে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকিউরিটি বক্স ভাঙচুর করে।
সকালে ছাত্রলীগকে ধাওয়া
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ১০টা থেকে শাহবাগে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে যোগ দিতে শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। আগে থেকে সেখানে ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতা অবস্থান করছিলেন। আন্দোলনকারীরা তাদের ধাওয়া দিলে তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) আশ্রয় নিয়ে ইটপাটকেল ছোড়েন।
বিএসএমএমইউর আওয়ামীপন্থি এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগের পদধারী কর্মচারীরাও ছাদ থেকে শাহবাগে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বিক্ষোভকারীরা বিএসএমএমইউতে গিয়ে তাদের ধাওয়া দেন। তারা বেশ কয়েকটি বাসে অগ্নিসংযোগ করেন। দুপুর ১২টার দিকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ বক্স ও পরিবাগে ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসাদুজ্জামানের কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। দিনভর বাংলামটর, শাহবাগ, টিএসসি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা ছিল আন্দোলনকারীদের স্লোগানে মুখর।
বিকেল ৩টার দিকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড় থেকে হেঁটে শাহবাগ মোড়ে আসেন আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি এসে কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এর পর তিনি শাহবাগেই ছিলেন। পরে সাড়ে ৫টার দিকে তিনি দিনের কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
- বিষয় :
- কোটা সংস্কার আন্দোলন
- নিহত
- কারওয়ান বাজার
- হামলা