কোটা সংস্কার আন্দোলন
এক বুলেটে আমার দুই নাবালক নাতি এতিম: শহীদ হাফিজুরের বাবা

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে নিহত হাফিজুল সিকদারের বাবা আবু বকর সিকদার। ছবি: সমকাল
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৪ | ১৪:১৫ | আপডেট: ১৪ আগস্ট ২০২৪ | ১৪:২২
‘আমার ছেলে রিকশা চালাইতো। ১৯ জুলাই মধ্য বাড্ডায় গোলাগুলি চলছিল তখন। এটা দেখে রিকশা চালায়ে বাড়ির দিকে আসার সময় ছাদ থেকে গুলিতে আমার ছেলে নিহত হয়। তার দুইটা বাচ্চা। এক বুলেটে আমার দুইটা নাবালক নাতি এতিম, তার বউ বিধবা’, কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় নিহত হাফিজুল সিকদারের বাবা আবু বকর সিকদার।
আজ বুধবার রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গণহত্যায় জড়িত স্বৈরাচার ও তার দোসরদের অবিলম্বে বিচারের দাবিতে জড়ো হন আবু বকর সিকদারের মত ৫০টিরও অধিক পরিবার। তারা ব্যানার ও ফেস্টুনে নিহত স্বজনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ছবি প্রদর্শন করেন। কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকে।
গত জুলাইয়ে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনের এ আন্দোলনে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের হামলা-গুলিতে নিহত হয়েছেন ৪৩৯ জনের বেশি ছাত্র-নাগরিক।
ছেলে হত্যার বিচার চাইতে মিরপুর থেকে এসেছেন বেবী খাতুন। হাতে শহীদ ছেলের ছবি। তিনি বলেন, ‘গত ৪ আগস্ট মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে পুলিশ আমার ছেলেকে গুলি করে। পরে আজমত হসপিটালে আমরা তার লাশ পাই। আমার একটামাত্র ছেলে। আমার ছেলেকে তারা হত্যা করেছে।’
শহীদ কাউসারের বন্ধু রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘গত ২০ জুলাই পুলিশ ও আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা লক্ষ্মীবাজারে আমাদের ওপর গুলি করে। এতে আমার বন্ধুসহ ছয়জন নিহত হয়। জনগণকে রক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা গুলি আমাদের ওপর চালানো হয়েছে, এ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। আমরা এ সন্ত্রাসীদের বিচার চাই।’
গাজীপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ আব্দুল্লাহ আল মামুনের পরিবারও বিচার চাইতে এসেছিলেন শহীদ মিনারে। কথা বলতে গিয়ে কান্না করে দেন মামুনের বোন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দুই বোনের একমাত্র ভাই ছিল সে। আমার বাবা একজন রেমিট্যান্স যোদ্ধা। ৫ আগস্ট আমার ভাইকে গাজীপুর আনসার একাডেমির সামনে গুলি করা হয়। এতে ভাইয়ের বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায়। এভাবে তাকে হত্যা করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমার মা পাগলপ্রায়। মা দুপুরে ভাত বেড়ে রেখেছিল, আবদুল্লাহ এসে ভাত খাবে। কিন্তু তার কাছে পৌঁছাল ছেলের লাশ। আমার বাবা মাসে মাসে রেমিট্যান্স পাঠায় কিন্তু এই দেশ তাকে উপহার দিয়েছে আমার ভাইয়ের লাশ।’
মানববন্ধনে শহীদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়’র মা সামসি আরা জামানও উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে যখন গুলি খেয়েছে তখন আমি রংপুরে আন্দোলনকারীদের সাহায্য করছি। মারা যাওয়া লোকগুলোর জন্যে আমি কেঁদেছি। কিন্তু যখন শুনলাম, আমার ছেলে গুলি খেয়েছে, তবে তার লাশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এবং পরে যখন তার লাশ পাওয়া গেল, তখন থেকে আমি আর কাঁদতে পারিনি। যারা মারা গিয়েছে তাদের জন্যে আমরা দোয়া করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন যেটা সবচেয়ে বেশি জরুরি, তা হলো যারা হাসপাতালের শয্যায় কাতরাচ্ছে তাদের জন্য এগিয়ে যাওয়া। আমার যদি সামর্থ্য থাকত, আমার এই অসুস্থ সন্তানদের চিকিৎসার ভার আমি নিতাম।’
মানববন্ধনে ‘শহীদ পরিবার ও নিপীড়িত ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে শেখ হাসিনাকে অতিদ্রুত দেশে এনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করাসহ সাত দফা দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি আন্দোলনে নিহত এবং আহতদের আইনি সহায়তার দানের জন্য ভুক্তভোগীদের তালিকাভুক্ত করে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি।
দাবিগুলো হলো: ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামালসহ সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে যারা গণহত্যায় জড়িত, এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছে এবং সরকারকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতাকারীদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা; গণহত্যায় জড়িত আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচার করা।
শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকাশ করা, শহীদদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও মাসিক আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা সরকারিভাবে করতে হবে; আন্দোলনে শহীদদের রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়া; বৈষম্য প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর (আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগের) গুণগত পরিবর্তন এবং জাতিসংঘের অধীনে গণহত্যার তদন্ত করে রিপোর্ট প্রকাশ করা।
মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস প্রমুখ।