ঢাকা ওয়াসা
প্রতাপশালী তাকসিমও এখন ‘ডুমুরের ফুল’

তাকসিম এ খান। ছবি: ফাইল
অমিতোষ পাল
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪ | ০৪:২৮ | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২৪ | ১১:২৬
হাসিনা সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে যেসব ব্যক্তি সব সময় আলোচনায় ছিলেন, তাদের একজন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান।
অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা কারণে বারবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হতেন তিনি। প্রভাবশালী অনেকের মতো তাকসিমও এখন ‘ডুমুরের ফুল’। তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগের দিন থেকেই তাকসিমের খবর নেই। তবে ৪ আগস্ট দুপুর ২টা পর্যন্ত তাঁর মোবাইল নম্বর খোলা ছিল। ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও বলতে পারছেন না তাকসিম কোথায়। তারা বলছেন, এমডি ঢাকাতেই আছেন। তবে গ্রেপ্তার এড়াতে বারবার স্থান বদলাচ্ছেন। তবে এমনও আলোচনা আছে, তাকসিমের পরিবারের সবাই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তিনি ছাড়া পরিবারের সবাই যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে পারেন।
তাকসিম এ খানের ব্যক্তিগত গাড়িচালক মাধবগোপাল সমকালকে বলেন, ‘গত ৪ আগস্ট স্যারকে অফিসে নামিয়ে দেওয়ার পর আমাকে চলে যেতে বলেন। এর পর আর স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। কয়েক দিন আগে গাড়িটি ওয়াসায় জমা দিয়ে এসেছি।’
জানা যায়, ওই দিন গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর অন্য একটি গাড়িতে করে তাকসিম অফিস ছাড়েন। এর পর আর অফিসে যাননি। নতুন উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হলে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে তাকসিম এ খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তাকসিমকে না পেয়ে ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) একেএম শহিদ উদ্দিনকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ডেকে নেওয়া হয়।
একেএম শহিদ উদ্দিন সমকালকে বলেন, গত রোববার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁর কুশল বিনিময় হয়। আগে এমডি না থাকলে তাঁকে ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব দিয়ে যেতেন। কর্মস্থলে এমডি অনুপস্থিত থাকলেও তিনি দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। এ কারণে সংস্থার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।
জানা যায়, ৮ আগস্ট রাত ১১টার দিকে তাকসিম এ খান তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে জুম মিটিং করেন। রোববার থেকে সবাইকে কর্মস্থলে উপস্থিত থাকার নির্দেশনা দেন। পাশাপাশি রোববার থেকে নিজেও অফিস করবেন বলে উল্লেখ করে তাদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘আমি ওয়াসার এমডি আছি, ভবিষ্যতেও থাকব।’
তবে ওই দিন তিনি অফিসে যাননি। সেদিন থেকেই তাকসিমকে গ্রেপ্তারের দাবিতে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিদিনই ওয়াসা ভবনে বিক্ষোভ করছেন। এ পরিস্থিতিতে তাকসিম গত সোমবার রাতে অনুগত কর্মকর্তাদের নিয়ে আবারও মঙ্গলবার দুপুর ২টায় জুম মিটিং আহ্বান করেন। তবে পরে ওই মিটিংয়ে যোগ দেননি তিনি।
তাকসিমবিরোধী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, তাকসিম কয়েক দিন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ওয়াসার এক প্রভাবশালী ঠিকাদারের বাসায় অবস্থান করেছেন। পরে একটি দেশের দূতাবাসে আশ্রয়ে থেকেছেন। কয়েক দিন হোটেল সোনারগাঁওয়ে থেকেছেন। ওয়াসারই একজন তাঁকে সোনারগাঁও হোটেলে প্রাতরাশ সারতে দেখেছেন। গত মঙ্গলবার রাতে হোটেল থেকে কেটে পড়েন তাকসিম।
ঢাকা ওয়াসায় সূত্র বলছে, বিএনপিপন্থি কয়েকজন কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, শ্রমিক দল নেতাকে তাকসিম অনেক সুবিধা দিয়েছেন। তারা তাকসিমকে ওয়াসাতে রক্ষার চেষ্টা করছেন। তাদের পরামর্শেই গতকাল পর্যন্ত তাকসিম পদত্যাগপত্র করেননি।
এ ব্যাপারে কথা বলতে ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যান সুজিত কুমার বালার সঙ্গে যোগাযোগ করে সমকাল। তবে তিনি সমকালের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তবে অন্য এক গণমাধ্যমকে সুজিত কুমার বালা জানান, বোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে তাকসিম পদত্যাগপত্র দেননি।
এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এস এম মোস্তফা তারেক বলেন, ‘এমডির সঙ্গে আমার গত ১ আগস্ট শেষ দেখা হয়। তিনি কোথায় আছেন, এ বিষয়ে আমার কাছে তথ্য নেই।’
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে প্রথম নিয়োগ পান তাকসিম। এর পর দফায় দফায় বাড়তে থাকে তাঁর মেয়াদ। সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে সপ্তমবারের মতো ওই পদে আরও তিন বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। দুর্নীতি, অনিয়মসহ নানা অভিযোগ থাকার পরও তাকসিমকে একই পদে দীর্ঘ সময় রাখা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ২০০৯ সালের পর থেকে ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়ে ১৬ বার। গত সাড়ে ১৫ বছরে ঢাকা ওয়াসায় একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তাকসিম।
তাকসিম এ খানের আমলে ঢাকা ওয়াসায় বৈদেশিক ঋণের টাকায় বেশ কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এ কারণে ওয়াসাকে ঋণের সুদ ও আসলের কিস্তি পরিশোধে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন প্রকল্পে ঢাকা ওয়াসার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা।
ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে তাকসিমের মাসিক বেতন বর্তমানে ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সর্বশেষ করোনা মহামারির মধ্যে এক লাফে ওয়াসার এমডির বেতন বাড়ানো হয় পৌনে ২ লাখ টাকা।
- বিষয় :
- ঢাকা ওয়াসা