ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ঝুঁকি নিয়ে ইতিহাসের দলিল সংগ্রহে আলোকচিত্রীরা

ঝুঁকি নিয়ে ইতিহাসের দলিল সংগ্রহে আলোকচিত্রীরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের হামলা থেকে বাদ যায়নি ছাত্রীরাও। ছবিটি তুলেছিলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের আলোকচিত্রী রোহেত আলী রাজীব

 ইন্দ্রজিৎ সরকার

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৪ | ০১:০৭

কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতনের এক দফা পর্যন্ত সংঘাত-সহিংসতায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা। এলোপাতাড়ি গুলি-সাউন্ড গ্রেনেডের আওয়াজ আর টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন সংবাদকর্মীরা। বিশেষ করে ঘটনাপ্রবাহের ভালো ছবি তোলা বা ভিডিও ধারণের প্রয়োজনে আলোকচিত্রী ও ক্যামেরাপারসনদের থাকতে হয়েছে সংঘর্ষস্থলের খুব কাছাকাছি। এতে আহতও হয়েছেন অনেকে। 

এদিকে ছবি না তোলার হুমকি ছিল আন্দোলনকারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উভয় পক্ষ থেকেই। তবে সব বাধা উপেক্ষা করে ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত ছবি-ভিডিও ধারণ করতে পিছপা হননি সাংবাদিকরা। তাদের কোনো কোনো ছবি-ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে মানুষের মনে। আন্দোলন হয়েছে আরও গতিশীল। কয়েক আলোকচিত্রী ও ক্যামেরাপারসনের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পেয়েছে সমকাল।

প্রথম আলোর আলোকচিত্রী খালেদ সরকার বলেন, গত ৪ আগস্ট সকালে উত্তরার আজমপুর এলাকায় ছিলাম। তখন উত্তরা হাই স্কুল থেকে মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারীরা সেখানে আসেন। কাছেই আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীর সমাবেশ ছিল। উভয় পক্ষে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গুলি ছুড়তে শুরু করে। আমার চোখের সামনেই আন্দোলনকারীদের দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সেই দৃশ্য আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না। ওই সময় গুলি করার, লাশ পড়ে থাকার কিছু ছবি আমি তুলেছি। সেগুলো পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার একটি ছবি ভাইরাল হয়েছিল। কাঁধে ব্যাগ, চোখে চশমা, নীল রঙের জামা পরা এক ছাত্রী হামলার মুখে জবুথবু হয়ে আছেন। তাঁর চোখ-নাক-মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। আলোচিত এই ছবিটি তোলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের আলোকচিত্রী রোহেত আলী রাজীব। তিনি জানান, সেদিন ওই শিক্ষার্থীর চোখে ইটের টুকরো লাগে। এর পর রক্তে ভরে যায় তাঁর মুখমণ্ডল। তার পরও হামলাকারীরা তাঁকে ছাড়েনি। এর মধ্যেই ছবিটি তোলা হয়।
রাজীব বলেন, ওই ঘটনার তিন দিনের মাথায় ১৮ জুলাই আমি আহত হই। সেদিন যাত্রাবাড়ীতে ব্যাপক সংঘর্ষ হচ্ছিল। খবর পেয়ে দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখি, আন্দোলনকারীদের ইটপাটকেলের জবাবে টিয়ার গ্যাসের শেল ছুড়ছে পুলিশ। এর আগে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় আগুন দেওয়া হয়। ছবি তোলা শুরুর পর হঠাৎ একটি ইটের টুকরো আমার গায়ে লাগলে পড়ে যাই। তখন ঢাকা টাইমসের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মেহেদী হাসানসহ অন্য সহকর্মীরা আমাকে তুলে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। মেহেদী আমাকে পানি খাওয়ান। তারপর চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফেরার দুই ঘণ্টা পর জানতে পারি, মেহেদী গুলিতে মারা গেছেন।

একই দিন উত্তরার আজমপুরে দায়িত্ব পালন করছিলেন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের স্টাফ ক্যামেরাপারসন হেমায়েত উদ্দিন হিমু। তিনি জানান, বিকেলে উত্তরা পূর্ব থানায় হামলা করে বিক্ষোভকারীরা। ফেসবুক লাইভের জন্য সে দৃশ্য ধারণ করতে থাকি। প্রথমে হামলার মুখে পুলিশ থানায় ঢুকে যায়। পরে ভবনের ছাদ থেকে টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। এ সময় থানাসংলগ্ন ফুট ওভারব্রিজ থেকে ভিডিও ধারণের সময় কয়েকটি স্প্লিন্টার আমার শরীরে লাগে। এর মধ্যে শিক্ষার্থীরা পিছু হটতে শুরু করলে পুলিশ থানা থেকে বেরিয়ে গুলি ছোড়ে। তখন মুহূর্তে চারজন গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তাদের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে পুলিশের গুলি এসে লাগে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের শরীরে। তিনিও লুটিয়ে পড়েন। অনিরাপদ ভেবে আমি দ্রুত স্থান ত্যাগের চেষ্টা চালাই। 
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের আলোকচিত্রী মাহমুদ জামান অভি বলেন, রামপুরায় বিটিভি ভবনে হামলার দিন আমি ওই এলাকায় ছিলাম। বিক্ষোভকারীদের ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের এক পর্যায়ে বিজিবি গুলি ছুড়তে শুরু করে। একটু পর আমি স্থানীয় একটি হাসপাতালের সিঁড়িতে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা একজনের রক্তাক্ত মরদেহ দেখতে পাই। তাঁর রক্তে পথ ভিজে গিয়েছিল। সেই রক্তের ওপর ছিল বুট জুতার ছাপ। আমি সেগুলোর ছবি তুলি। 

অভির তোলা কিছু ছবি ভাইরাল হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৪ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চারজনের মরদেহ নিয়ে মিছিলের একটি ছবি। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সংসদ ভবনের অধিবেশন কক্ষে চেয়ারে উঠে লোকজনের লাফালাফির দৃশ্যও রয়েছে।

আরও পড়ুন

×