ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সেন্ট গ্রেগরিসহ ৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ভাঙচুর

পুরান ঢাকায় ৩৫ কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

সেন্ট গ্রেগরিসহ ৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ভাঙচুর

ঢাকার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা করেন। রোববার দুপুরে তোলা -সমকাল

 জবি প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৪ | ০১:১৫ | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৪ | ০৭:৫২

রাজধানীর সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ এবং ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ইনস্টিটিউট হাসপাতালসহ পাঁচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংঘবদ্ধভাবে হামলা চালানো হয়েছে। গতকাল রোববার দুপুরের পর ব্যাপক ভাঙচুর করে বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। শুধু শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজেরই ১৭টি বিভাগে হামলা করা হয়। বিভাগগুলোর অফিস থেকে লুটপাট করা হয়েছে কম্পিউটার ও অন্য সামগ্রী। ভাঙচুর করা হয়েছে কলেজের একটি মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার ও চারটি মোটরসাইকেল। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা চলছিল। হামলাকারীরা ওই সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেছে। 

এ ঘটনার রেশ ধরে সন্ধ্যায় সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর ও আগুন দেয় কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা। অতর্কিত হামলা চালিয়ে কলেজটির প্রথম থেকে তৃতীয় তলা তছনছ করা হয়। শিক্ষক ও স্টাফরা জানান, কলেজের শ্রেণি ও শিক্ষক রুমসহ অন্তত ৫০টি কক্ষে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। ক্যান্টিনে হামলা করে লুট করা হয়েছে টাকা। এ ছাড়া দ্বিতীয় তলায় একটি শিক্ষক কক্ষে অগ্নিসংযোগ করা হয়। 

কলেজের শিক্ষক রিচার্ড গোমেজ বলেন, সন্ধ্যায় কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা আমাদের কলেজে হামলা চালায়। তারা ভেতরে ঢুকে দু’জন স্টাফকে বেধড়ক মারধর করে। আমাদের কলেজ যখন ছুটি হয়, তখন ওই কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা রাস্তায় ছিল। তারা হয়তো ভেবেছে, তাদের ওপর আক্রমণে আমাদের কলেজের শিক্ষার্থীরাও ছিল। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীরা ক্লাসেই ছিল। 

কলেজের ফাদার ব্রাদার প্লাসিড পিটার রিবেরু সমকালকে বলেন, কলেজ ছুটি হয়েছে দুপুর ১২টায়। অফিসিয়াল কাজ শেষ করে আমরা ৪টার মধ্যে সবাই চলে যাই। পরে খবর পেয়ে এসে দেখি এই অবস্থা। 

সূত্রাপুর থানার ওসি সাইফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, সেন্ট গ্রেগরি, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট, সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। পরিস্থিতি শান্ত করতে গেলে পুলিশের এপিসির ওপর হামলা হয়। দু’জন পুলিশ আহত হয়েছেন। একটি অস্ত্রের ম্যাগাজিন খোয়া গেছে। এসব ঘটনায় মামলা হবে। 

গতকাল দুপুর ১টার পর রাজধানীর অন্তত ৩৫টি কলেজের শিক্ষার্থীরা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের সামনের ফটক অবরোধ করে গেট ও নেমপ্লেট ভাঙচুর করে ভেতরে প্রবেশ করে। পরবর্তী সময়ে পার্শ্ববর্তী সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের ভেতরে প্রবেশ করে হামলা ও ভাঙচুর করে তারা। এ সময় সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের দিক থেকে কিছু শিক্ষার্থী লাঠিসোটা নিয়ে এগিয়ে এলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ধাওয়া দিয়ে সোহরাওয়ার্দী কলেজের দিকে যায়। এ সময় উভয় পাশ থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপে বেশ কয়েকজন আহত হয়। 

জানা যায়, ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে ডা. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিৎ হালদার গত ১৬ নভেম্বর ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি হন। ১৮ নভেম্বর হাসপাতালে মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ২০ ও ২১ নভেম্বর হাসপাতাল অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, ওই দিন ন্যাশনাল মেডিকেলের পক্ষ নিয়ে কবি নজরুল এবং সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী ও দুই কলেজের ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর আক্রমণ করে। 

বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের দাবি, অভিজিৎকে হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা দেওয়া হয়। তারা এর বিচার চাইতে যান। এর পর তাদের মারধর করা হয়। এ প্রতিবাদেই অন্য সব কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানান। পূর্বঘোষিত ‘সুপার সানডে’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের সামনে জড়ো হন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। ফেসবুকে গ্রুপ ‘ইউনাইটেড কলেজ অব বাংলাদেশ’ নামের গ্রুপে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ অন্য কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে একত্র হয়।

তাদের মধ্যে ডা. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা আইডিয়াল কলেজ, সিটি কলেজ, গিয়াসউদ্দিন কলেজ, সরকারি তোলারাম কলেজ, ইম্পেরিয়াল কলেজ, বোরহানউদ্দিন কলেজ, বিজ্ঞান কলেজ, লালবাগ সরকারি কলেজ, উদয়ন কলেজ, আদমজী, নটর ডেম, রাজারবাগ কলেজ, নূর মোহাম্মদ, মুন্সি আব্দুর রউফ কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী কলেজ, গ্রিন লাইন পলিটেকনিক, ঢাকা পলিটেকনিকসহ রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ অংশ নেয়।

মারা যাওয়া অভিজিতের এক বন্ধু বলেন, আমরা অভিযুক্ত ডাক্তারের লাইসেন্স বাতিল করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই। এ ছাড়া আমাদের ওপর যারা হামলা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে ন্যাশনাল মেডিকেলের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে জানান কবি নজরুল কলেজের ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক কাওসার হোসেন। 

এদিকে কলেজে ভাঙচুর করে লুট করা প্রশাসনিক কাগজপত্র ফিরিয়ে দিতে আজ রাত ১০টার মধ্যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা। রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে কলেজের শিক্ষার্থী লিখন ইসলাম বলেন, হামলাকারীরা পরীক্ষার্থীদের কাগজপত্র ছিঁড়ে ফেলেন। পুড়িয়েও দেওয়া হয়। ভাঙচুর ও লুটের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রশাসন, সরকার ও উপদেষ্টারা এই দাবি না মানেন, তাহলে কবি নজরুল এবং সোহরাওয়ার্দী কঠোর কর্মসূচিতে যাবে। 

কলেজ ভাঙচুরের বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক তরিকুল ইসলাম বলেন, আমি তাদের একবার বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। পরে দলবল নিয়ে আবার এসেছে। অনেক কম্পিউটার ও বিএনসিসির রাইফেল নিয়ে গেছে। এক শিক্ষকের গাড়ি ও চারটি মোটরসাইকেল ভেঙেছে।

সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ড. কাকলী মুখোপাধ্যায় বলেন, আজ (রোববার) পরীক্ষা ছিল। শনিবার রাত পর্যন্ত তাদের কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানায়, তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে, কিছু হবে না। দুপুরে তারা গেট ভেঙে ঢুকেছে। ইচ্ছামতো ভাঙচুর করেছে। গ্যাসলাইন ছেড়ে দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের মার্কশিট, খাতা, ল্যাপটপ কিছুই নেই। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জানিয়েছি। 

কোতোয়ালি থানার পুলিশ পরিদর্শক নাসির উদ্দিন বলেন, বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা রোববার ন্যাশনাল মেডিকেল হাসপাতালের সামনে অবস্থান নেন। এতে পুরান ঢাকার ব্যস্ত জনসন রোডে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। 

লালবাগ জোনের ডিসি জসিম উদ্দিন বলেন, আজকের (রোববার) বৈঠকে ছাত্র প্রতিনিধি ও মৃতের বাবার হাসপাতালে আসার কথা ছিল, তারা আসেননি। কিন্তু সকালে ফের শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে আসেন। তারা যাত্রবাড়ী থেকে অনেক সংখ্যায় এসেছে। বিকেলে তাদের বোঝাতে সক্ষম হলে চলে যায়।

এদিকে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন। পাশাপাশি হেনস্তার শিকার হন সাংবাদিকরাও। ইত্তেফাকের ভুক্তভোগী সাংবাদিক জাকির হোসেন বলেন, আমি লাইভে ছিলাম। হঠাৎ করেই ছেলেরা আক্রমণ করে। ফোন, বুম কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলে। 

ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের পরিচালক ব্রি. জে. (অব.) ডা. ইফফাত আরা বলেন, শিক্ষার্থীরা যে অভিযোগ করছে ভুল চিকিৎসায় মারা গেছে, এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। একটি তদন্ত কমিটিও গঠন হয়েছে। অন্য কলেজ কীভাবে জড়াল– এই প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা জানি না তারা কীভাবে এলো। আমরা তাদের কোনো সাহায্য চাইনি। 

আরও পড়ুন

×