ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

মস্তক ছাড়াই তরুণের মৃতদেহ নিয়ে গ্রামে গেলেন স্বজনরা

কী করে খুলব এই কফিন!

কী করে খুলব এই কফিন!

প্রতীকী ছবি

সাহাদাত হোসেন পরশ

প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২০ | ০৮:২০ | আপডেট: ১৬ জুন ২০২০ | ০৮:২৪

‘তবু এই কফিনটাই সম্বল। কফিনের ভেতরে থাকা ভাইয়ের লাশটা মা-বাবাকে দেখাতে পারবো না। এই কষ্ট সহ্য করার নয়। কী করেই বা লাশটা দেখাব। ভাইয়ের প্রিয় মুখখানাই তো নাই। মস্তকবিহীন লাশ নিয়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছি। কী নৃশংস ওরা। এভাবে হত্যা করতে পারল আমার ভাইকে? ফেরীতে পদ্মা পার হওয়ার সময় খবর এলো লাশের বাকি অংশ পাওয়া গেছে। আবার ফিরে যাওয়ার অবস্থা নেই। এক আত্মীয়কে ফোনে বলেছি ভাইয়ের লাশের বাকি অংশ পুলিশের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে গ্রামে আসতে। কিভাবে মা-বাবাকে এমন মর্মন্তুদ ঘটনা বলব।’

এমন করুণ অভিব্যক্তি মো. হোজায়ফার। তার ছোট ভাই হেলাল উদ্দিন (২৬) নৃশংস হত্যার শিকার হন। সোমবার অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবে হেলালের মরদেহের কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত পাওয়া যায় দক্ষিণখান থানাধীন মুক্তিযোদ্ধা সড়কের ১০৯ নম্বর বাসা ও হাজি আব্দুস সালাম সড়কের সংযোগস্থলে কাঁচাবাজার সংলগ্ন এলাকায় একটি বস্তায়। ওই দিনই বিমানবন্দর থানাধীন ইশান কলোনীর বটতলা পানির পাম্পের সামনে ডাস্টবিনে মাথাহীন লাশের অপর অংশ পাওয়া যায়। ভাইয়ের মোবাইল বন্ধ পেয়ে নরসিংদী থেকে ঢাকায় দক্ষিণ খানের বাসায় খোঁজ নিতে যান হোজায়ফা। ফিঙ্গার প্রিন্ট থেকে ছবি পাওয়া, হাত-পায়ের আঙুল, জামা-কাপড় অন্যান্য আলামত দেখে সোমবার মধ্যরাতে ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করেন তিনি। এরপর মঙ্গলবার ময়নাতদন্তসহ অন্যান্য আইনি বিষয় শেষ করে মস্তকবিহীন লাশ নিয়েই অ্যাম্বুলেন্সে গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের নেছারাবাদের দই হাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি।

হোজায়ফা সমকালকে জানান, তার ভাই হেলাল উদ্দিনের দেড় বছর ধরে দক্ষিণখান থানাধীন আজমপুরের মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটে বিকাশ ও নগদের এজেন্ট ছাড়াও ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসা ছিল। সেখানে একটি মেসে থাকতেন হেলাল। সোমবার সকাল ৮টার দিকে হেলালের বোন জামাই জাহিদ হোজায়ফাকে ফোন করে বলেন, হেলালের রুমমেট আলামিনের কাছ থেকে তিনি জেনেছেন, রোববার রাতে বাসায় ফেরেননি হেলাল। ওই দিন সকাল ৭টার দোকান খুলতে বাসা থেকে বের হয়ে যান হেলাল। এরপর থেকে তার চারটি মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। বোন জামাইয়ের কাছ থেকে ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার খবর জানতে পেরে নরসিংদীর কর্মস্থল থেকে সোমবার ঢাকায় আসেন হোজায়ফা। এরপর আশপাশের দোকানীদের কাছ থেকে হেলালের ব্যাপারে জানতে চান তিনি। তারা জানান, রোববার দুুপুুরের পর হেলালকে মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট এলাকায় দেখা যায়নি। ভাইয়ের সন্ধান না পেয়ে সোমবার দুপুরে দক্ষিণ খান থানায় যান  হোজায়ফা। এসময় থানার ডিউটি অফিসার তাকে জানান, দুই থানা এলাকায় লাশের খণ্ডিত অংশের খোঁজ মিলেছে। দ্রুত পুলিশের সঙ্গে ঘটনাস্থলে যান তিনি। সেখানে গিয়ে দেখেন সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা রয়েছেন। তারা মস্তকবিহীন লাশের ওপরের অংশ থেকে দুই হাতের আঙুলের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়ার পর একটি ছবি বের করে তাকে দেখান। ওই ছবি দেখার পরই তার ভাইয়ের পরিচয় নিশ্চিত করেন তিনি।

হোজায়ফা বলেন, অনলাইন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট হওয়ায় তার কাছে সবসময়ই ২-৩ লাখ টাকা থাকত। হয়ত কোনো চক্র ওই টাকা মোবাইলের ভেতর থেকে হাতিয়ে নিতে তার কাছে গোপন পিন নম্বর চেয়েছিল। পিন নম্বর জানাতে বিলম্ব হওয়ায় তাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর পৃথক তিনটি এলাকায় মৃতদেহের বিভিন্ন অংশ গুম করে রাখার চেষ্টা করে। কারও সঙ্গে তার ভাইয়ের শত্রুতা ছিল না। টাকা হাতিয়ে নিতেই এমন বর্বরতার  শিকার হন তার ভাই।

হোজায়ফা আরও বলেন, আমাদের তিন ভাই-বোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। হেলালের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছিল। কিছু দিনের মধ্যে তাকে বিয়ে করানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তার আগেই এমন ভয়ঙ্কর ঘটনার মুখোমুখি হতে হলো।

জানা গেছে, হেলালের বাবা পিরোজপুরের একটি মসজিদের ইমাম। তার মা গৃহিনী। তারা দুই ভাই দুই বোন। ঘটনার পর তার মা-বাবাকে জানানো হয়েছে, ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এমন নৃশংসভাবে ছেলেকে হারানোর বিষয়টি শোকাতুর মা-বাবা জানেন না।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তর বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে টাকা হাতিয়ে নিতেই তাকে খুন করা হয়েছে। ডিবি ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করেছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, সোমবার প্রথমে দক্ষিণখানের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান,বস্তাবন্দি মরদেহের একটি অংশ পড়ে রয়েছে। এরপর কিছু সময় পর বিমানবন্দর থানা পুলিশ জানতে পারেন, তাদের এলাকায় লাশের একটি খণ্ডিত অংশ মিলিছে। লাশের দুই অংশ দুই থানা এলাকা থেকে উদ্ধার হলেও মাথা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত সর্বশেষ মঙ্গলবার বিকেলে দক্ষিণ খান থেকে মিলল ওই খণ্ডিত মাথা। 

আরও পড়ুন

×