ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ফ্লাইওভারের রাজস্বে লুকোচুরি

ফ্লাইওভারের রাজস্বে লুকোচুরি

কোলাজ

 লতিফুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:১৮ | আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:৩১

হাসিনা সরকারের পতনের পর হানিফ ফ্লাইওভারের (যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান) রাজস্ব নিয়ে ফের লুকোচুরি শুরু করেছে ওরিয়ন গ্রুপ। এর আগে ফ্লাইওভার উদ্বোধনের পরবর্তী সাত বছর চুক্তি অনুযায়ী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে (ডিএসসিসি) রাজস্বের এক কানাকড়িও দেয়নি বিনিয়োগ ও তত্ত্বাবধায়নকারী প্রতিষ্ঠানটি। পরে উপায়ান্তর না দেখে ২০২০ সালের জুলাইয়ে ডিএসসিসি ফ্লাইওভারের সাত স্থানে টোলঘর তৈরি করে দেয়। পাশাপাশি গাড়ি চলাচলের সমীক্ষাও করে সংস্থাটি। সমীক্ষা অনুযায়ী যে পরিমাণ রাজস্ব ডিএসসিসির তহবিলে যাওয়ার কথা, তার তিন ভাগের এক ভাগ টাকাও দেয়নি ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার।

গত জুলাই-আগস্টের টোলের ৭৫ লাখ টাকা চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করার কথা বলা হলেও বাস্তবে ব্যাংক হিসাবে টাকা মেলেনি। আর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে টোলের লভ্যাংশের রাজস্বের এক টাকাও জমা দেয়নি ওরিয়ন। সিটি করপোরেশন থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চিঠি চালাচালি আর সভা করেও ফল মেলেনি।

সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার টোল থেকে বছরে আয় করে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সেই অনুযায়ী বছরে কয়েকশ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। ডিএসসিসির দাবি, সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ীও ওরিয়ন থেকে রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না। ২০২০ সালের আগের সাত বছর এক টাকাও রাজস্ব দেয়নি। পরে তারা তাদের মন মতো টাকা দেয়, গাড়ি চলাচলের প্রকৃত সংখ্যাও জানায় না। এখন থেকে ইক্যুইটি শেয়ার বেনিফিটের রাজস্বের টাকা আদায়ে ফ্লাইওভারে প্রযুক্তির মাধ্যমে গাড়ি গণনা করবে ডিএসসিসি।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, হানিফ ফ্লাইওভার ২০১৩ সালে উদ্বোধনের পর থেকে বেলহাসা একম জেভি ও অ্যাসোসিয়েটসের (বর্তমানে ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার) ২৪ বছর মালিকানা ভোগ করার কথা। সে সময় বিনিয়োগকারী ও তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠানকে দৈনিক ৪৩ হাজার ২৮৩টি গাড়ি চলাচলের নিশ্চয়তা দেয় সরকার। কোনো কারণে গাড়ি চলাচল কম হলে ফ্লাইওভারের মালিকানার সময় আরও বাড়ানো হবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়। আর ফ্লাইওভারে দৈনিক ৬৫ হাজার ৫৮১টির বেশি গাড়ি চললে ৫ শতাংশ হারে ইক্যুইটি শেয়ার বেনিফিটের রাজস্ব পাবে ডিএসসিসি।

পরে ২০২০ সালের জুলাইয়ে তৎকালীন মেয়র ফজলে নূর তাপস যোগাযোগ করলে ওরিয়ন জানায়, চুক্তি অনুযায়ী ফ্লাইওভার দিয়ে পর্যাপ্ত গাড়ি না চলায় তারা লভ্যাংশ দিচ্ছে না। পরে ডিএসসিসি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ফ্লাইওভারে সাতটি টোল প্লাজা বসায় এবং জরিপ করে। করোনার সময় করা ওই জরিপে ফ্লাইওভার দিয়ে প্রতিদিন ৯৪ হাজার ৩৫৩টি গাড়ি চলাচলের প্রতিবেদন দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, করোনাকালে ফ্লাইওভার দিয়ে তুলনামূলক কম গাড়ি চলাচল করে। করোনা এবং পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ফ্লাইওভার দিয়ে গাড়ি কয়েক গুণ চলাচল কর­লেও নতুন করে কোনো সমীক্ষা আর রাজস্ব বাড়েনি করপোরেশনের।

২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ইক্যুইটি শেয়ার বেনিফিটের রাজস্বের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, এই সময়ে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশনকে দিয়েছে ৩২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। সর্বশেষ গত জুলাই-আগস্ট মিলিয়ে ডিএসসিসিকে ৭৫ লাখ টাকার সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের তিনটি চেক দেয় ওরিয়ন। এই তিন চেকের বিপরীতে ব্যাংক থেকে কোনো টাকা তোলা যায়নি। পরে চিঠি চালাচালি আর সভার পর আরেকটি ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ২৫ লাখ টাকার চেক দেয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু সে সময় বাকি থাকে আরও ৫০ লাখ টাকা। পরে করপোরেশনের প্রশাসকের সঙ্গে সভা করেও কাজ হয়নি। পরে আরেকটি চিঠি ওরিয়ন গ্রুপসহ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে দিলে চলতি সপ্তাহের শুরুতে ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে। এবারও চলাচল করা গাড়ির সংখ্যা জানায়নি তারা। তবে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের রাজস্বের টাকা পরিশোধ করেনি তারা। 

এদিকে, সড়ক ও জনপথ বিভাগের হিসাব বলছে, হানিফ ফ্লাইওভারে প্রতি ঘণ্টায় যানবাহন চলে ৮ থেকে ১০ হাজার। এক দিনে গাড়ি চলে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার। বছরে গাড়ি চলে ৭০ কোটি ৮০ হাজারটি। সেই হিসাবে টোল আদায় হওয়ার কথা বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তবে সিটি করপোরেশনে গত তিন বছরে জমা দেওয়া রাজস্বের টাকা অনুসারে ওরিয়নের ফ্লাইওভার থেকে আয় বছরে ১৪০ কোটি থেকে ১৭৮ কোটি টাকা। 

সরেজমিন দেখা গেছে, ১১ দশমিক ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ফ্লাইওভারটির ওঠার ছয়টি ও নামার সাতটি পথ রয়েছে। নামার পথগুলোর মধ্যে গুলিস্তানে দুটি, সায়েদাবাদে দুটি, দোলাইরপাড়ে একটি, ডেমরা রোডের কাজলায় একটি ও শনির আখড়ায় একটি টোলপ্লাজা আছে। এর মধ্যে শনির আখড়া থেকে গুলিস্তানে বেশি যানবাহন চলে। ফ্লাইওভার ঘুরেও দেখা গেছে, নির্দিষ্ট টোলপ্লাজা বাদ দিয়েই ফ্লাইওভারের বিভিন্ন পয়েন্টে চালকদের হাতে রসিদ ধরিয়ে টোল তুলছেন ওরিয়নের পোশাক পরিহিত কিছু ব্যক্তি। এভাবে টাকা নেওয়ার হিসাব থাকছে না কম্পিউটারের সফটওয়্যারে। এ সময় দিনে কতসংখ্যক যান চলাচল করে, তা জানতে গুলিস্তান টোলপ্লাজায় গেলে সংশ্লিষ্ট কেউ তথ্য দিতে রাজি হননি। তারা ওরিয়নের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে তৎকালীন সরকার অসম চুক্তি করে। সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করপোরেশনকে এক টাকাও দেয়নি। মেয়র তাপস জরিপ করে রাজস্ব আদায় শুরু করলেও তারা সেই অনুযায়ী চলাচলকারী গাড়ির রাজস্ব দেয়নি। পরে মেয়র তাদের প্রতি মাসে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা রাজস্ব দিতে বললে তাও দেয়নি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর আগের চেয়ে ফ্লাইওভার দিয়ে গাড়ি চলাচল বেড়েছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এখন আর টাকা দিচ্ছে না।

ডিএসসিসির ওই কর্মকর্তা বলেন, ফ্লাইওভার দিয়ে কী পরিমাণ যানবাহন যাতায়াত করে, ওরিয়ন টাকা কম বা বেশি দেয় কিনা, এর কোনো তথ্য ডিএসসিসির কাছে নেই।

ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, আগে সিটি করপোরেশনে রাজস্ব জমা না হলেও দু’পক্ষের যোগসাজশে ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই লাভবান হয়েছেন। তবে ফ্লাইওভার থেকে সিটি করপোরেশনের যে প্রাপ্য, সেটি তাদের দিতে হবে। এখন প্রযুক্তির মাধ্যমে ফ্লাইওভারের গাড়ি গণনা করে নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব আদায় করা হবে।

ফ্লাইওভারের টোলের বকেয়াসহ সামগ্রিক বিষয়ে জানার জন্য ওরিয়ন গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান এরফানুল আজিমকে ফোন এবং হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এবং চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিমের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ওরিয়নের মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের হটলাইন নম্বরে একাধিকবার চেষ্টা করলেও কেউ ধরেনি।

 

আরও পড়ুন

×