ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বেইলি রোড ট্র্যাজেডির এক বছর, সুপারিশের একটিরও বাস্তবায়ন নেই

বেইলি রোড ট্র্যাজেডির এক বছর, সুপারিশের একটিরও বাস্তবায়ন নেই

রাজধানীর বেইলি রোডে পুড়ে যাওয়া গ্রিন কোজি কটেজ ভবন। গত বছর ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে আগুনে এখানে ৪৬ জন মারা যান। ভবনটি এখন পড়ে রয়েছে ভূতুড়ে অবস্থায়। বৃহস্পতিবার তোলা সমকাল

 অমিতোষ পাল

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০১:৩৭ | আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ১০:৩১

রাজধানীর বেইলি রোডের কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর গঠিত রাজউকের তদন্ত কমিটির ছয়টি সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে রাজধানী ঢাকা কার্যত একটি অগ্নিকুণ্ডলীর মধ্যেই রয়ে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। 

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান সমকালকে বলেন, ‘কোজি কটেজ ট্র্যাজেডির পর গণমাধ্যমের চাপে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো কিছু হম্বিতম্বি করল। পরে আর সেটি থাকেনি। তারা (কর্তৃপক্ষ) বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আঁতাত করে রাজউক ইমারত নির্মাণ বিধিমালার সংশোধন করছে। নকশা পাস করছে। কিন্তু ভবনটি সঠিকভাবে নির্মিত হচ্ছে কিনা, সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা, তা দেখছে না। অন্যদিকে অধিকতর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও রাজউক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কোনো ইন্সপেক্টর বা অথরাইজড অফিসারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। গত এক বছরেও তাদের চোখ-কান খোলেনি।’ 

রাজউকের তদন্ত প্রতিবেদনে তাদের ছয়টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে রাজধানীর অগ্নিঝুঁকি অনেকটা কমে যাবে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। এর প্রথমটিতে ভবন ব্যবহারের সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) ছাড়া কোনো ভবনে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সেবা সংযোগ না দেওয়ার সুপারিশ রয়েছে। অথচ কোনো কোনো ভবন মালিক নির্মাণকাজ শুরু করলেই আবেদন করে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে যুক্তি দেখানো হয়েছে, নির্মাণকাজের জন্য পানি ও বিদ্যুৎ প্রয়োজন। ফলে বিদ্যুৎ বিভাগ ও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যবসার স্বার্থে পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ দিয়েছে। অথচ রাজউক কোনো বাধা দেয়নি।

রাজউকের দ্বিতীয় সুপারিশ ছিল, যারা ভবন নির্মাণের নকশা করেন, নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার পর তারা যেন নির্মাণকাজে অনিয়ম থাকলে তা উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেন। অথচ গত এক বছরে রাজধানীতে শত শত নতুন ভবন উঠলেও কোনো ভবনের নির্মাণকাজে সামান্যতম অনিয়ম হয়েছে বলে রাজউকের ইন্সপেক্টর, অথরাইজড অফিসার, ভবনের স্থপতি বা সাইট ইঞ্জিনিয়ারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ দেওয়ার নজির পাওয়া যায়নি। 

প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলপি গ্যাস সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়মিত পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিশ্চিত করবে বলে রাজউকের তৃতীয় সুপারিশে বলা হয়েছে। কিন্তু এলপি গ্যাস সরবরাহকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কখনোই কোনো ভবনে গিয়ে তাদের সরবরাহ করা সিলিন্ডারগুলো ভোক্তা সঠিক নিয়মে ব্যবহার করছে কিনা, সেটি তদারক করেনি। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ কোনো ভবনে গ্যাসের চুলা সঠিকভাবে ব্যবহার করছে কিনা, তা কখনও পরিদর্শন করছে বলে নজির পাওয়া যায়নি। তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে ভবন মালিকের কাছ থেকে নিয়মিতভাবে মোটা অঙ্কের মাসোহারা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। মাঝেমধ্যে লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে কিছু সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও পরে তারাই আবার অবৈধ পুনঃসংযোগের ব্যবস্থা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

চতুর্থ সুপারিশ ছিল, পাঁচতলা বা তদূর্ধ্ব আবাসিক কাম বাণিজ্যিক বা শিল্পকারখানার ভবনে প্রতি তিন মাস পর অগ্নিমহড়া পরিচালনা করাটা বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ ছিল চতুর্থ সুপারিশে। বাস্তবে দেখা গেছে, দুয়েকটি ভবন মালিক নিজ উদ্যোগে মাঝেমধ্যে মহড়া চালিয়েছেন। পছন্দমতো দুয়েকটি ভবনে মহড়া চালিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ। এর ছাড়া তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। 

রাজউকের পঞ্চম সুপারিশে ফায়ার লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নের ক্ষেত্রে রাজউকের ব্যবহার সনদ বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ফায়ার কর্তৃপক্ষ কিছুটা সচেতন থাকলেও রাজউকের দেওয়া ব্যবহার সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) ইস্যুর বেলায় উৎকোচ বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। ফলে অনেক ভবন মালিক অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নিতে আগ্রহ দেখাননি। রাজউক অনুমোদিত সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট আছে। বাকি ৯৫ শতাংশ ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেই। এ ব্যাপারে কখনও কোনো তৎপরতা দেখায়নি রাজউক।

আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু না করার সুপারিশ রয়েছে। কিন্তু রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স শাখা এই নির্দেশ মানে না। ট্রেড লাইসেন্স শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের রাজস্ব আদায়ের জন্য লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। এ জন্য আমরা ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে দিই। সেটি বাণিজ্যিক, নাকি আবাসিক, এটি দেখা হয় না। শুধু ভবন মালিকের সঙ্গে করা চুক্তিপত্র থাকলেই ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়।’

রাজউকের ছয় সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য এক সমন্বয় সভায় বলা হয়েছে, সেবা সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে। এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকায় থাকবে রাজউক, সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কোনো সংস্থার তদারকি কখনও চোখে পড়েনি।
বর্তমানে কোজি কটেজটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এই ভবনের আগে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে মারা যান ৭১ জন। একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলী ট্র্যাজেডিতে মারা যান ১২৪ জন। এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সরকারি সংস্থাগুলোর অবহেলার বিষয়টি আগেও উঠে এসেছিল। তখনও প্রায় একই ধরনের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু কখনোই তা বাস্তবায়ন হয়নি।

এ প্রসঙ্গে রাজউকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ছিদ্দিকুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘অগ্নিদুর্ঘটনা কমাতে বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি গঠন করা হয়েছে। এতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি আছে। আমি কয়েকটি ভবন পরিদর্শন করেছি। সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলেছি। নকশা পাসের সময় কে কোন ডিজাইন করছে, তাদের স্বাক্ষর ও পরিচয় রাখা হচ্ছে। রাজউক নিয়মিত ভবন পরিদর্শনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আদালতের আদেশে রেস্টুরেন্টগুলো খুলে দেওয়া হলেও তারা শর্ত মানছে কিনা, সেটিও দেখা হচ্ছে। নতুন ভবন তৈরির সময় রাজউকের লোকজন তদারকি করছে।’

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ফায়ার সার্ভিস বসে নেই। প্রতিদিনই কোনো না কোনো জায়গায় অগ্নিনির্বাপণ মহড়া চালাচ্ছে। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর অনেক সংস্থা মিলে কিছু সমন্বিত কাজ করার কথা ছিল। সেই কাজের অগ্রগতি কী, সেটা ফায়ার সার্ভিস বলতে পারবে না। তবে এটুকু বলতে পারি, ফায়ার সার্ভিস বসে নেই। তারা নিয়মিত কাজ করছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, নগরবাসীর মধ্যে জনসচেতনতা তৈরি করতে প্রচারণা চালানো হয়েছে। সবাই যেন ভবন নির্মাণের সময় বিল্ডিং কোড অনুসরণ ও ফায়ার সেফটি নিশ্চিত করে।

 

আরও পড়ুন

×