জেনেভা ক্যাম্পে সংঘর্ষ, পুলিশের গাড়িতে আগুন

বিক্ষোভের একপর্যায়ে অগ্নিসংযোগ করে বিহারীরা- সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ | ১০:১১ | আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৯ | ০৯:১৬
বিনামূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবিতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দারা রাস্তায় নামলে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিক্ষোভকারীরা পুলিশের গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেলও ছোড়ে তারা।
একপর্যায়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে শতাধিক রাউন্ড টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে পুলিশ। সংঘর্ষের সময় অন্তত ১৫ পুলিশ সদস্য ও অর্ধশত বিহারি আহত হয়েছেন। গতকাল শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত থেমে থেমে চলে এই সংঘর্ষ। এ ঘটনায় পুলিশ ছয় বিহারিকে আটক করেছে।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) নির্বাহী পরিচালক এটিএম হারুন অর রশিদ সমকালকে বলেন, 'প্রতিমাসে জেনেভা ক্যাম্পের বিদ্যুৎ বিল হয় এক কোটি ২০ লাখ টাকা। এই বিল পরিশোধ করে আসছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। তবে ক্যাম্পের বাসিন্দারা এ দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার পর থেকে মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ বিল দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছর পর্যন্ত ওই মন্ত্রণালয় বিল পরিশোধ করেছে। পরে ক্যাম্পবাসীকে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের জন্য চিঠিও দেওয়া হয়। তবে বিহারিরা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করছে না। বর্তমানে ৩৩ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।'
পুলিশ এবং জেনেভা ক্যাম্পের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে নারাজ জেনেভা ক্যাম্পবাসী। এ অবস্থায় মাসখানেক ধরে ক্যাম্পে ১০-১২ ঘণ্টা লোডশেডিং থাকে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবিতে ক্যাম্পবাসী শুক্রবার রাতে রাস্তায় নামে। পুলিশ বুঝিয়ে সরিয়ে দেয় তাদের।
শনিবার দুপুর ১২টার দিকে আবার তারা ক্যাম্পের পাশের গজনবী সড়কসহ আশপাশের সড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। এ অবস্থায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর (মোহাম্মদপুর এলাকা) হাবিবুর রহমান মিজান ক্যাম্পের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ঘটনাস্থলে বৈঠক করে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা রাস্তা থেকে সরতে নারাজ। কাউন্সিলরকে তারা নাজেহাল করে বলেও জানা যায়। এরই মধ্যে পুলিশ আসে ঘটনাস্থলে। পুলিশ রাস্তা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বার বার অনুরোধ করে তাদের। তবে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় তারা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাদের সরানোর চেষ্টা করলে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশও লাঠিচার্জ শুরু করে। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয় পুলিশের সঙ্গে। একপর্যায়ে রেসিডেন্সিয়াল কলেজের পেছনেও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের একটি গাড়ি ভাংচুর এবং পুলিশের আরেকটি পিকআপ ভ্যানে আগুন লাগিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা।
এ ছাড়া আশপাশের বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ভাংচুর চালায় তারা। একপর্যায়ে পুলিশ টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। দুপুর আড়াইটায় পুলিশ ক্যাম্পের ভেতর অভিযান চালিয়ে ছয় বিহারিকে আটক করে।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার আনিসুর রহমান সমকালকে বলেন, 'বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ বার বার তাগিদ দেওয়ার পরও জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দারা বকেয়া বিল পরিশোধ করেনি। এ বিষয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান গতকাল সকালে তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। আলোচনার একপর্যায়ে তারা কাউন্সিলরের ওপর হামলা চালায়। সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তারা পুলিশের ওপরও হামলা করে এবং পুলিশের একটি গাড়ি ভাংচুর ও আরেকটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষোভকারীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শতাধিক রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। বিহারিদের হামলায় অন্তত ১৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। দুপুর আড়াইটার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। পরে ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে ছয়জনকে আটক করা হয়েছে।'
ক্যাম্পবাসীর অভিযোগ- কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানের লোকজনও তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তবে কাউন্সিলরের দাবি, তার লোকজন ক্যাম্পে যায়নি। তিনি একাই ঘটনাস্থলে যান। তিনি সমকালকে বলেন, 'বিহারিরা বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার পরই তাদের বিদ্যুৎ বিল সরকার থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিদ্যুৎ বিল তাদের পরিশোধের জন্য বলা হয়। কিন্তু তারা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এখন তাদের লোডশেডিং হয়। এ নিয়ে তারা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে।'
উর্দুভাষী যুব-ছাত্র আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জুনায়েদ জুয়েল বলেন, 'প্রায় এক মাস ধরে জেনেভা ক্যাম্পে নিয়মিত বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা লোডশেডিং থাকে। বিদ্যুতের দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্যাম্পের লোকজন শনিবার গজনবী রোডে অবস্থান নিলে পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এতে অন্তত ৫০ জন বিহারি আহত হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।'
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, শনিবার গুলিবিদ্ধ হয়ে রকি হোসেন নামে এক যুবক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। তার গলা, মুখ ও ডান চোখে ছররা গুলি লেগেছে। তার বাসা জেনেভা ক্যাম্পে। তার খালাতো ভাই মিঠু জানান, রকি ক্যাম্পের পাশে একটি মোটরসাইকেল গ্যারেজে কাজ করে। সে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। গুলিবিদ্ধ হওয়ায় সে ডান চোখে দেখতে পাচ্ছে না।
আলামিন নামে এক বিহারি বলেন, রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের ক্যাম্পে বিদ্যুৎ থাকে না। এতে তাদের সন্তানদের পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে। জহির নামে আরেকজন বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় তাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যাঘাত ঘটছে।
জেনেভা ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, ক্যাম্পের মধ্যে শুধু আবাসিক বাসাবাড়িই নয়, সেখানে লেদ মেশিন, বিভিন্ন গ্যারেজ থেকে শুরু করে কুটির শিল্পকারখানা রয়েছে। সেসব কারখানায়ও বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়।
- বিষয় :
- জেনেভা ক্যাম্প
- মোহাম্মদপুর