গলির মুখে গেট বসিয়ে সাইদের মাসে আয় কোটি টাকা

মমিনুল হক সাইদ
অমিতোষ পাল
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ | ১৫:০৬ | আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ | ১৫:৪৩
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের (আরামবাগ-ফকিরাপুল) কাউন্সিলর একেএম মমিনুল হক সাইদ এলাকাবাসীর নিরাপত্তার কথা বলে তার এলাকায় অলি-গলির মুখে ১৬টি লোহার গেট বসিয়েছেন। এসব এলাকায় রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত দু'জন করে নিরাপত্তাকর্মী দায়িত্ব পালন করেন। গেট বসানো ও নিরাপত্তাকর্মীদের বেতন বাবদ তিনি কক্ষপ্রতি (ফ্ল্যাট বা বাড়িপ্রতি নয়) প্রতি মাসে আদায় করেন ১০০ থেকে ৫০০ টাকা। ওই এলাকায় এভাবে ৩০ হাজার কক্ষের মালিক বা ভাড়াটিয়াকে এই টাকা দিতে হয়। এ থেকে প্রতি মাসে আদায় হয় অন্তত কোটি টাকা। এসব ফটক দিয়ে কোনো আসবাব, ইট-বালু বা অন্যান্য জিনিসপত্র ঢোকাতে গেলে দিতে হয় অতিরিক্ত মোটা অঙ্কের টাকা। একজন নিরাপত্তাকর্মীর মাসে বেতন দেন ৫ হাজার টাকা। জনপনেরো নিরাপত্তাকর্মীর পেছনে মাসে লাখখানেক টাকা ব্যয় করেও প্রতি মাসে কোটি টাকার ব্যবসা হয় তার। অথচ মমিনুল হক সাইদের ভয়ে এলাকাবাসী এ ব্যাপারে মুখ খুলতে পারেন না। তিন বছর ধরে এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন কাউন্সিলর সাইদ।
অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে সম্প্রতি অভিযান শুরুর পর সামনে চলে আসে মমিনুল হক সাইদের নাম। তবে কেবল ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগই নয়, ওই এলাকায় বাড়ি দখল, ফ্ল্যাটের কাজ বন্ধ করে ডেভেলপারের কাছ থেকে চাঁদা বা ফ্ল্যাট আদায়, ফুটপাতে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করে চলেছেন। এলাকায় যেসব দোকানপাট রয়েছে, তাদেরও চাঁদা দিতে হয়। জোর করে ওই এলাকার কারখানার শ্রমিকদের মিছিলে নিয়ে যান। এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপ করে এ রকম অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া দুই মাস আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রতিমন্ত্রীর আত্মীয় জানান, ওই প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রীর একটি প্লট ছিল আরামবাগ এলাকায়। তার স্ত্রী প্লটটি একটি ডেভেলপারকে দেন। ডেভেলপার কাজ শুরু করতে গেলে মমিনুল হক সাইদ বাধা দেন। তিনি ওই ভবনের চারটি ফ্ল্যাট দাবি করেন। ডেভেলপার দিতে অস্বীকৃতি জানালে কাজ বন্ধ করে দেন। এক পর্যায়ে প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রী বিষয়টি লিখিত আকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানান। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উদ্যোগে তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা মেলে। ওই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে মমিনুল হক সাইদের বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ পায় একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর দিনই মীর কাসেম আলীর মালিকানাধীন ৮৯ ও ৮৯/১ আরামবাগ কালভার্ট রোডের আটতলা বিপিএল (বাংলাদেশ পাবলিকেশনন্স লিমিটেড) ভবনটি সাঙ্গপাঙ্গো নিয়ে দখল করে নেন মমিনুল হক সাইদ। ভবনটিতে শখানেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিটির ভাড়া ৬ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। প্রতি মাসে এ ভবনের ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে ৭-৮ লাখ টাকা ভাড়া আদায় করছেন তিনি।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনটিতে দৈনিক স্বাধীন বাংলা নামে একটি পত্রিকা অফিসসহ প্রেস, রঙ, যন্ত্রাংশের দোকানসহ বিভিন্ন ধরনের দোকান রয়েছে। কিন্তু দোকান মালিকরা এসব নিয়ে মুখ খুলতে চান না।
জানা যায়, দখলের পরপরই মার্কেট পরিচালনা কমিটির লোকজন ও জামায়াতের কিছু অনুসারী মার্কেটটি দখলমুক্ত করার ব্যাপারে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা কার্যালয়ে সভা করেছিলেন। পরে তারাও মমিনুল হক সাইদের রোষানলে পড়েন। এখন আর কেউ এ নিয়ে মুখ খোলেন না।
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ভবনের পেছনে ও বিপিএল ভবনের পাশেই প্রায় এক বিঘা জমির ওপর একটি বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করে ডেভেলপার কোম্পানি ডোম ইনো। সেখানে একাধিক ফ্ল্যাট দাবি করেন মমিনুল হক। ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর কাজ বন্ধ করে দেন তিনি। এক বছর ধরে দেনদরবার চলে। সম্প্রতি আবার পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে ডোম ইনোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান। আরামবাগের মেরিনার্স ক্লাবের পাশেও একটি ডেভেলপারের বহুতল ভবন থেকে দুটি ফ্ল্যাট দাবি করার অভিযোগ আছে মমিনুলের বিরুদ্ধে।
১৮৮ আরমাবাগ সার্কুলার রোডের একটি পুরনো বহুতল ভবনের জাল দলিল করে বছর তিনেক আগে দখলে নেন মমিনুল হক। এ নিয়ে ওই ভবনের ভাড়াটিয়ারা আপত্তি করলেও পরে তা ধোপে টেকেনি। বর্তমানে ওই ভবন নিয়ে দু'পক্ষের মামলা চলছে। ভবনটির নিচতলায় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের একটি অফিস রয়েছে।
দু'বছর আগে আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাব দখলে নেন মমিনুল হক সাইদ। আগে আরামবাগ ক্লাবের সভাপতি ছিলেন নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। নানা কৌশল করে মমিনুল সভাপতি হয়ে যান। দুটি ক্লাবেই দেদার ক্যাসিনো চলেছে এতদিন। ওখান থেকে তার প্রতিদিন বিপুল আয় হয় বলে স্থানীয়রা জানান।
বছর তিনেক আগে কমলাপুর স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলার রেফারিংয়ের ঘটনার সূত্র ধরে মমিনুল হক তার লোকজন নিয়ে বাফুফে ভবন ও সেখানে রাখা গাড়িগুলো ভাংচুর করে। এ ঘটনায় একদিন মতিঝিল থানা হাজতে থাকতে হয় তাকে।
গুলিস্তান-মতিঝিল এলাকার ফুটপাত থেকে অবৈধ হকার উচ্ছেদ করতে গেলে তিনি বাধা দেন। এক পর্যায়ে মেয়র সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। কারণ মতিঝিল এলাকার ফুটপাতে হকার বসিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা তুলতেন মমিনুল হক। পরে তিনি তার এলাকার প্রেস ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের হকার সাজিয়ে মেয়রের বিরুদ্ধে মিছিল করান। এছাড়া শাপলা চত্বরের পাশে সন্ধ্যায় মাছ-তরকারির দোকান থেকে চাঁদা না পাওয়ায় সেটা বন্ধ করে দেন তিনি। পরে সমঝোতা হওয়ায় আবার শুরু হয়।
স্থানীয়রা জানান, এসব অপকর্ম করার জন্য মমিনুলের রয়েছে বিশেষ একটি বাহিনী। এর মধ্যে রয়েছে দিলকুশা ক্লাবের আবদুল মান্নান, আরামবাগের বাবু, স্থানীয় যুবলীগের জামাল, মতিঝিল থানার ছাত্রলীগ নেতা হাসান প্রমুখ। মাসের মধ্যে ১৫ দিনই তিনি সিঙ্গাপুরে থাকেন। অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর কয়েকদিন আগেও তিনি সিঙ্গাপুর যান। স্থানীয়রা বলছেন, এবার আর সহসাই হয়তো দেশে ফিরবেন না মমিনুল।
- বিষয় :
- মমিনুল হক সাইদ
- কোটি টাকা
- ডিএসসিসি
- চাঁদাবাজি